মুসলিম পোর্ট

ফিলিস্তিনি গ্রামের মহিলাদের দ্বারা প্রচলিত এক পারম্পরিক শিল্প হচ্ছে অঞ্চলটির এম্রয়ডারি (বিশেষ স্থানীয় সুতা কাজ)। যা বর্তমানে অবরুদ্ধ দেশটির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটি একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে এটি বিশেষত নির্যাতিত ফিলিস্তিনি ও দেশটি থেকে বিতাড়িত অভিবাসীদের মধ্যে বেশ সমাদৃত। এমনকি ধীরে ধীরে পোষাকটি হানজালা কার্টুন চরিত্র, চামচ কিংবা জয়তুন গাছের মতই এক প্রতিবাদী প্রতিকী ভাষায় রূপ লাভ করেছে।

এই ধরনের সুতাকাজ কে তারতীজ বলা হয়। ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO) পোষাকটিকে ফিলিস্তিনি এমব্রয়ডারি অথবা তারতীজ হিসেবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করে।

তারতীজ হচ্ছে একটি প্রাচীন বুনন পদ্ধতি যা কি না কানানি যুগেও (৩০০০ বছর আগে আরব অঞ্চলে বসবাসরত জাতি) বেশ প্রসিদ্ধ ছিলো। এটি শতবর্ষ ধরে ফিলিস্তিনিদের মাঝে ব্যবহৃত হচ্ছে – বিভিন্ন রঙ এবং নকশা সামাজিক এবং সাম্প্রদায়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

দৃষ্টিনন্দন এই পোষাকটি ফিলিস্তিনের একটি প্রাচীন শৈল্পিক প্রথা যা কিনা মা থেকে মেয়ে এভাবে বংশ পরম্পরায় চর্চিত হয়ে আসছে। গ্রাম ভেদে নকশার তারতম্যও দেখা যায়। ফিলিস্তিনে প্রসিদ্ধ নকশাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রস-টিচ এবং কাউচিং স্টিচ।

যদিও গত ৫০ বছরে ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট প্রচুর পরিবর্তিত হয়েছে। ফিলিস্তিনে তাতরীজ বুনন এখনো এক জীবন্ত হস্তশিল্প। অনেক ফিলিস্তিনিকেই এই শিল্প তার দাদা-পরদাদার সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয় বা এটি পরম্পরায় চলে আসছে।

প্রায়শই উপলব্ধ নকশা এবং রঙ সাধারনভাবে ব্যবহৃত হয় যা পরিধানকারী এবং কারিগরের পরিচয়ও অনেকাংশে বহন করে করে।

পাশাপাশি, এই অনন্য এবং সূক্ষ্ম শীল্পের মৌলিক অংশ হলো- এই বোঝা যে, তাতরীজ ফিলিস্তিন এবং তার জনগনের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে থাকে, স্থানীয়দের স্থায়ীত্ব ও মৌলিকত্ব প্রমাণ করে। যা মূলত বহিরাগত কিংবা দখলদার শক্তির বিপরীতেও ফিলিস্তিনের একটি সাংস্কৃতিক অস্ত্র এটি।

তাই বলা যায়, একটি তাতরীজ নকশা কেবলমাত্র রঙ ও সুই-সুতা দিয়েই একজন ব্যক্তির গল্প এবং ঐতিহ্য বলে দিতে পারে।

এখানে, লেভান্টাইন মোটিফগুলো মাতৃসূত্রীয় ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক ঐঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। একই সাথে বাণিজ্য রুট, টেক্সটাইল এবং রঞ্জক এর উন্নয়ন প্রতিফলিত করে।

তাতরীজে ব্যবহৃত প্রথাগত জ্যামিতিক নকশার সাথে যুক্ত হয় আশেপাশের পরিবেশগণ প্রভাব। যা এর কারিগরের ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্দেশ করে। তাতরীজ আসলে একটি সম্মিলিত স্মৃতি সঞ্চয়ের মাধ্যম।

ক্রস-টিচ যা আসলে (ফেল্লাহুন, Farmers= কৃষক) নামেও পরিচিত। এটি হচ্ছে ফিলিস্তিনের অন্যতম প্রসিদ্ধ সূচি- শৈলী। এই সূচ-শৈলীর এই ধরনের নামের কারন হচ্ছে এটি একসময় দক্ষিণ থেকে মধ্যাঞ্চলের গ্রামে বসবাসকারী নারীদের মধ্যে বেশি চর্চা হতো।

ফিলিস্তিনি ক্রস-টিচ প্রসিদ্ধ এর রঙ এবং বুননের নিপুনতার জন্য। একই সাথে অঞ্চলভেদে এর নকশার বিভিন্নতার জন্য।

ফিলিস্তিনি এম্ব্রয়ডারিতে মানাজেন(সংযোগ সেলাই) তাশরাইম(প্যাচওয়ার্ক) এবং জালদেহ (হেমিং সেলাই) এর মিশণে এক বিস্তারিত টেকনিক এর সম্মেলনে তৈরী।সাধারণ ক্রস-টিচের থেকে এই সেলাই গুলোতে বেশি দক্ষতা এবং নৈপূন্যের প্রয়োজন হয়।

তারতীজ বুননে সাধারনত তুলার অথবা রেশমের সুতা ব্যবহার করা হয়। রেশমের সুতা সাধারণত থোব নামের বিশেষ পোশাকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যা বিয়ের মতো বিশেষ আয়োজনে পরিধান করা হয় এবং তুলার সুতা দিয়ে নিত্য দিনের পরিধেয় থোব তৈরী করা হয়।

নারীরা নিপুনভাবে প্রাকৃতিক রঙ এবং বুনন উপকরণ দিয়ে পোশাক, জ্যাকেট, কুশন, টেবিলক্লথ এবং বালিশের নকশা করে। যদিও পোশাকই হচ্ছে সব থেকে বেশি জনপ্রিয় নকশাকৃত পণ্য।

গ্রাম্য নারীদের পোশাকে সাধারণত একটি লম্বা জামা,পাজামা, একটি কোটি, একটি মাথার পাগড়ি সদৃশ অলংকার এবং ওড়না থাকে। প্রতিটি কাপড়েই গাছ, পাখি এবং ফুলের নকশার বুনন থাকে।

কাপড়ের রঙ এবং নকশা একজন নারীর অবস্থানগত পরিচিতি, বৈবাহিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থাও নির্দেশ করে। পোশাকটিতে ঢিলে-ঢালা অংশটিকে থোব বলে, যার উপরের অংশে, হাতে এবং কাফে নকশা করা থাকে।

নিত্যদিনের পোশাক রেশম দিয়ে তৈরী হলেও বিশেষ অনুষ্ঠানের পোশাক সর্ণ এবং রুপার সুতা দিয়ে তৈরী হয়। ঐতিহ্যবাহী বিয়ের পোশাকগুলো নকশা করা কাপড়ের স্তর এবং সামুদ্রিক পাথর এবং সোনা রুপার কয়েন দিয়ে সাজানো হয়।

পোশাক তৈরীর কাচামাল গুলো পরিবারের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান এমনকি তাদের জন্মস্থান ও নির্দেশ করে। যেহেতু, কাজটি সময় সাপেক্ষ তাই ঐতিহ্যবাহী নকশাগুলো ছিড়ে গেলে তা ছোট করে কেটে নতুন ছোটো পণ্যে রুপান্তর করা হয়।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি নাকবা সংঘটিত হয়। সে সময়ে প্রায় ৭০০,০০০ অধিক লোক ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জায়নবাদি ইজরায়েল কর্তৃক ব্যপক চাপের মধ্যে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তখন এই শিল্পটি বিস্মৃতিও ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায়। সেই থেকে এটি ফিলিস্তিনের একটি প্রতীক হয়ে উঠতে শুরু করে।।

মহিলারা তাদের থোব ( ঐতিহ্যবাহী নকশা করা বিশেষ পোশাক) পরিধান করতেন অথবা তা তারা তাদের পিঠে বহন করতেন। যাতে তাদের নিজস্ব ভূমিকে তারা সংস্কৃতির মাধ্যমে স্মরণ রাখতে পারেন। এই ঐতিহ্যবাহী নকশা এখনো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষিত হয়ে আসছে।

ঐতিহাসিকভাবে তাতরীজ প্যাটার্ন গ্রামভেদে আলাদা ছিলো যেহেতু তখন যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ছিলো না। কিন্তু ১৯৪৮ সালে, যখন শরনার্থী শিবিরে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একত্রে বসবাস শুরু করে তখন নকশার পার্থক্য লোপ পায়।

শিল্পটি এখনো ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনের মাঝে বিশেষ ভুমিকা পালন করছে। যেহেতু ফ্যাশন ডিজাইনাররা এবং শিল্পীরা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে জীবিত রাখতে চায়, ফলে তারা সম্মিলিতভাবে এই শিল্পকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করছে।

তাতরীজ কেবলমাত্র একটি শোভা নয়, বরং একটি ভাষা, রঙ এবং বৈচিত্রে ধারাবাহিকতার প্রতীক। তাতরীজ সমস্ত ফিলিস্তিনিদের স্বকীয়তা তৈরির একটি উপায়, একটি আন্দোলনের ভাষা, তাদের দেশ প্রেম, তাদের ঐতিহাসিক মৌলিকত্ব, সম্মান এবং তাদের প্রাচীন সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষ পরিধেয়। যা বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে যারা জায়নবাদী দখলদার ইসরায়েলের হাত থেকে আলকুদস, মসজিদুল আক্বসা ও ফিলিস্তিনের মুক্তি চায়, তারাও তারতীজকে একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে।

অনুবাদক- তাসমিমা হাসান তুসি