মুসলিম পোর্ট

বায়তুল মাকদিসের নাম শুনলেই প্রতিধ্বনিত হয় হাজার বছরের ইতিহাস। অবলীলা কল্পনায় ভেঁসে উঠে কত শত নবী রাসূলদের বাস্তব চিত্র। এই বায়তুল মাকদিসকে ঘিরেই লাখো কোটি স্বপ্ন বুনেছেন রাসূল প্রেমী সাহাবী ও মনীষীরা। অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁজা টগবগে প্রান। সেই সুরভি এখনও যেনো বায়তুল মাকদিসের আঙ্গিনায় ভেঁসে আসে। বায়তুল মাকদিসের প্রতিটি বালুকণায় মিশে আছে সেই সংগ্রামী মহান মুজাহিদদের সুবাসিত ঘামের সুগন্ধ। আল আকসার প্রতিটি ইট আলিঙ্গন করে রেখেছে সিজদায় অবনত তাঁদের কপালের চিহ্নগুলোকে। 

এই বায়তুল মাকদিসকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর ইতিহাসের সকল নবী রাসূলদের আবেগ অনুভূতি ও ভালোবাসার মেলবন্ধন নির্মিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাজার বছরের স্বর্নালী সভ্যতার ভীত। 

বায়তুল মাকদিস কেন মুক্ত করতে হবে? এই প্রশ্ন সামনে রেখে আমাদের আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। 

বায়তুল মাকদিস কি?

* বায়তুল মাকদিস কেন নবী, রাসূল, সাহাবী ও ৷ মনীষিদের নিকট এতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ?

* বায়তুল মাকদিস মুক্তির উদ্দেশ্য কি? 

* আল আকসা মুক্ত করা কেনইবা এতো গুরুত্বপূর্ণ?

* কুদুস মুক্ত পরবর্তী পৃথিবীর অবস্থা কেমন হবে? 

বায়তুল মাকদিস কি?

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে আমাদের পৃথিবীর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে ভালোভাবেই অনুধাবন করতে হবে।

আমাদের সামনে একটা বয়ান চালু আছে, বায়তুল মাকদিস হচ্ছে তিন ধর্মের (ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলিম) পবিত্র একটি স্থান। এই তিন ধর্মকে নিয়েই পৃথিবীর ইতিহাস সুগঠিত হয়েছে। কিন্তু কাল ক্রমে এগুলো নানা দিগবেদিক মোড় নিয়েছে।

এ নিয়েই একটা ছোট উপস্থাপনা করা যাক, এই বায়তুল মাকদিস অঞ্চল তিন ধর্মের পবিত্র স্থান হওয়ার কারণটা যদি আমরা নৈতিক দিক থেকে চিন্তা করি তা হলো, যেমন ইহুদিরা মনে করেন মুসা (আ:) মিশর থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলো এজন্য এটা তাদের কাছে পবিত্র স্থান। 

অন্যদিকে খ্রিষ্টানরা মনে করেন ঈসা (আঃ) এখানে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিলো এবং পরবর্তীতে সৃষ্টিকর্তা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যান। 

এজন্য এটা খ্রিষ্টানদের কাছেও পবিত্র ভূমি। 

অন্যদিকে বায়তুল মাকদিস আমাদের মুসলিমদের কাছে প্রথম কিবলা। কারণ আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) নবুয়াতের প্রথম ৭ বছর পর্যন্ত বায়তুল মাকদিসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করছেন৷ 

এখন কথা হলো ইহুদী এবং খ্রিষ্টানরা মূসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ) কে কেন্দ্র করে বায়তুল মাকদিস কে পবিত্র ভূমি মনে করেন। অথচ তাঁরাও তো আমাদেরই ইসলামের নবী। 

তবে ঐতিহাসিকগণ এখানে তিন ধর্মের পবিত্র স্থান এটা প্রকাশ করতে আগ্রহ পোষণ করেন না। কারন, তিন ধর্ম বলতে কিছু নয় বরং এ সমস্ত কিছু আমাদেরই/ মুসলমানদেরই অঞ্চল। তবে, সকল ধর্মের লোকদের এখানে স্বাধীনতা থাকবে। এখানে তিন ধর্ম বলে স্বীকৃতি দেয়াটা ইজরাইলকে স্বকৃীত দেয়ার নামান্তর। এটা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক বিষয়ে নয় বরং এটা একই সাথে রাজনৈতিক বিষয়। কেননা- এই ফিলিস্তিন তথা কুদুস অঞ্চল যতদিন আমাদের হাতে ছিলো ততদিন এখানে শান্তি বিরাজমান ছিলো। যখনি এটা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যায় তখন থেকেই গোটা বিশ্ব বিশৃংঙ্খলায় ব্যাপক ছয়লাব হয়েছে। 

যাইহোক, আমরা এটার শুরুর দিক থেকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে একটু পর্যালোচনা করে দেখি, খ্রিষ্টপূর্ব ১৯ শতকের দিকে ইব্রাহিম (আ:) প্রথমে এই অঞ্চলে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে আসেন এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ১০ শতকের দিকে দাউদ (আ:) দাওয়াত আসেন৷ তিনি এখানে প্রায় ৩৩ বছরের মত রাজত্ব করেন। অতঃপর নবীপুত্র হযরত সুলাইমান (আ:) এর হাতে রাজত্বের চাবিকাঠি ন্যাস্ত করে যান। 

বায়তুল মাকদিসের সীমানা

আমরা জানি, বায়তুল মাকদিসের বর্ডার হিসেবে যে অঞ্চলটাকে ধরা হয় সেই বর্ডারটা তিনিই (সুলাইমান আ:) প্রথম তৈরি করেন যা পরবর্তী প্রায় ৫৮৭ সনের দিকে বাবিলরা ধ্বংস করে দেয়। এখনও ঐ দেয়ালটা ওখানে চিহ্নিত অবস্থায় আছে। বর্তমানে যেখানে ইহদীরা এসে মনের ইচ্ছা কামনা বাসনা পূর্ণের জন্য দোআ করে, কান্নাকাটি করে। 

তবে বাবিলরা এই বর্ডার ধ্বংস করার পরে আবার ঐ বর্ডার নির্মান করা হয়। 

কিন্তু,পরবর্তীতে আবার যখন রোমনরা এই অঞ্চলটাতে আসে তখন তারা বর্ডারটা পুনরায় ধ্বংস করেনি বরং সেখানে মূর্তি তৈরি করে। 

এরপর যখন আবার সেখানে খ্রিষ্টানরা আসে তখন তারা সেই ইহুদী নির্মিত মুর্তিটাকে ভেঙে ফেলে ৷ কেননা তারা মনে করে তাদের বাইবেলে লিখা আছে ঐ স্থানে যেনো “একটা ইটের ওপর অন্য কোন ইট না আসে “। এজন্য এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তারা তা ভেঙে ফেলে। 

এরপর আবার যখন ৭০০ শতাব্দীর দিকে হযরত ওমর (রা:) খলিফা হন তখন তিনি এই কুদুস কে কেন্দ্র করে আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। অতঃপর তিনি তাদের নিয়ে শামের (বর্তমান সিরিয়ার) দিকে যাত্রা করেন এরপর বায়তুল মাকদিসে জয় করেন । সেখানে একটি মসজিদ স্থাপন করেন ঠিকই। তবে যেখানে খ্রিষ্টানরা ইবাদত করত সেই স্থানের উপর কোন চাপ প্রয়োগ করেননি পূর্বের ন্যায় ভেঙেও ফেলেন নি বরং ভিন্ন জায়গায় মসজিদ স্থাপন করেছিলেন । 

কেননা, 

ইসলাম সর্ব অবস্থায় মানুষকে তার ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়, চিন্তার স্বাধীনতা দেয়। 

– আর ইসলাম তো ফাসাদ সৃষ্টি করতে আসেনি বরং ইসলাম এসেছে ইসলাহ করতে। 

(এই সকল বিষয়গুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সীরাতের বই থেকে আমরা জানতে পারি)। 

প্রিয় পাঠক,

ইতিমধ্যে আমরা বায়তুল মাকদিসের প্রথম দিকের কিছু বিষয় সম্পর্কে একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছি। 

এবার আসুন কুদস এর সর্বশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১০৯৯ সালে যখন ক্রুসেডরা কুদুস গ্রহন করে তার ঠিক ৮০ বছর পর এবার আসুন কুদস এর সর্বশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১০৯৯ সালে যখন ক্রুসেডরা কুদুস গ্রহন করে তার ঠিক ৮০ বছর পর সালাউদ্দীন আইয়ুবীর নেতৃত্বে বায়তুল মাকদিস মুসলিমদের হাতে চলে আসে। এরপর তিনি সকলের জন্য এই পবিত্র ভূমিকে উন্মুক্ত করে দেন।

কারণ পূর্ববর্তী সময়গুলোতে যখন ইহুদীদের হাতে বায়তুল মাকদিসের কর্তৃত্ব আসতো তখন তারা খ্রিষ্টানদের উপর নির্যাতন করতো আবার খ্রিষ্টানদের হাতে আসলে তারা ইহুদীদের ওপর চরম নির্যাতন করতো। অথচ সালাহউদ্দিন আইয়ূবী সকলের জন্য এই কুদুসকে উন্মুক্ত ও নিরাপদ করে দেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা তো আর থেমে থাকেনি। তারা ঠিকই পর্দার অন্তরাল থেকে মুসলিমদের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র শুরু করে যা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী বুঝতে সক্ষম হননি। তা হলো সেই কুদসে আবারও শত্রুরা একে একে ঢুকতে থাকে। এর মধ্যে আবার সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী কুদস বিজয়ের ছয়বছর পূর্তি হতে না হতেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এরপর থেকে আবার এখানে মুসলিমদের কতৃত্বের চাবি কাঠিও ধীরে ধীরে বিনিষ্ট হতে থাকে। অতঃপর ১২২৯ সালে এটি আবার খ্রিষ্টানদের হাতে চলে যায় পরবর্তী আবার ১২৪৪ সালে এটি আবার মুসলমানদের হাতে চলে আসে। 

এই সময়টাতে যখন মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা ছিলো তখন সেলজুকরা আবার ধীরে ধীরে এদিকে আগাতে থাকে। যেমন বায়তুল মাকদিস এর অংশ যেটা এখন আমরা শুধুমাত্র ফিলিস্তিন অঞ্চলের মধ্যেই ধরে থাকি। সে সময় এটা শুধু মাত্র ছোট একটা অংশই ছিলোনা বরং ঐ সময়ে ফিলিস্তিন অঞ্চল ছিলো গাজা, লুত, কুদুস, খলিল, মাদুস এবং এই ছয়টি অঞ্চলকেই কুদুস এর সীমানা হিসেবে ধরা হতো। এই ছয়টি অঞ্চল ছিলো শামের মধ্যে। এ বিষয়টা আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার, ঐ সময় সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন বলতে কিচ্ছু ছিলোনা বরং মূল বিষয় হলো সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন এই নাম তিনটা মুসলিমদের দেয়া কোন নাম না। এগুলো ইংরেজদের তৈরি করা । 

এর পর ইহুদিরা ধীরে ধীরে আলেয়া নামে একটা মুভমেন্ট শুরু করে।

★ ১ম আলেয়া:- ইহুদীরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে বর্তমান ফিলিস্তিনের দিকে ঝুঁকতে থাকে এবং এসে কৃষি কাজের দিকে মনোনিবেশ করে। 

তাদের একটা বৈশিষ্ট হলো তারা যেখানে যায় সেখানে প্রথমে কৃষিকাজ শুরু করে এরপর ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করা শুরু করে। এখন ব্রিটেনদের তথা ব্রিটিশদের একটা বিষয় হলো, তারা যেখানে যায় সেখানে খুব কমই যুদ্ধ করে দেশ কিংবা অঞ্চল জয় করে। তবে শেষে একটা যুদ্ধ করলেও বরং তারা সেখানে নানাবিদ পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের জাল আঁটতে থাকে। 

তার একটা বিষ্ময়কর উদাহরণ হলোঃ- থিউরেডর হার্জেল যখন ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা করে সেখানেও তারা বহুমুখী প্ল্যান নিয়ে আগাতে থাকে। ইউরোপের মধ্যে থেকে তাদের সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখেন ওয়েজব্যান নামে এক ব্যাক্তি তিনি হলেন একাধারে একজন বিজ্ঞানী একই সাথে একজন ডিপ্লোমেট(কূটনৈতিক)। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় যখন হিটালারের নাজি গ্রুপকে হারানো খুব কষ্টদায়ক হয়ে যাচ্ছিলো তখন ইহুদীরা একচ্ছত্র ভাবে তাদের সহয়তা করে। 

সাধারণ ইহুদীদের বাসেলে যে মিটিং টা সংগঠিত হয়েছিলো তখন থেকেই তারা তাদের কর্মতৎপরতা শুরু করে। আচ্ছা তাহলে তাদের তৎপরতার প্রথম ধাপটা কি ছিলো তা জানা যাকঃ উসমানীয়দের সময় তারা দ্বিতীয় খলিফা আব্দুল হামিদের কাছে গিয়ে বলে – “আমাদের ধারগুলো শোধ করে দিবো এর বিনিময়ে তোমরা আমাদের এই অঞ্চল টুকু দিয়ে দাও “। আমরা সকলেই জানি তার সেই বিখ্যাত উক্তি- “বায়তুল মাকদিসের মাটি টাকার বিনিময় দেওয়ার মতো নয়। আমরা এই ভূমি রক্তের বিনিময়ে নিয়েছিলাম। তোমাদের যদি নিতে হয় তবে রক্তের বিনিময়েই নিতে হবে।” 

তখন তারা বলেছিল আচ্ছা সেটা বাদ দিন। তাহলে আমাদের জন্য অন্তত ঐ অঞ্চলে একটা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করতে দিন। আমাদের একটা সংস্থা আছে, এজন্য একটা প্রতিষ্ঠান খুবই জরুরি। তিনি তখনও নিষেধ করে দিয়েছিলেন কারন ইহুদিদের ষড়যন্ত্র তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন সকলের পূর্বেই।

★ ২য় আলেয়া:-

ইহুদিদের দ্বিতীয় আলেয়া সংগঠিত হওয়ার জন্য সবথেকে বড় প্লানটা ছিলো,

তারা উসমানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শের গ্রুপ তৈরি করে। আমরা জানি, ১৯১৭ এর দিকে উসমানী খেলাফতের ভীত এমনিতেই দূর্বল হয়ে যাচ্ছিলো। এই দূর্বলতার সুযোগে তারা উসমানীয়দের সংবিধান পরিবর্তন করার জন্য ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে এবং তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে। সেই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোই পরবর্তীতে খেলাফতের উপর মারাত্নক চাপ সৃষ্টি করে। এর মাঝে সবথেকে বড় আউটপুট হলো ১৯১২ সালে উসমানী খেলাফতে একটি আইন তৈরি হয় তা হলো অন্য ধর্মের লোকেরাও এখন থেকে কুদসে স্থায়ী বাড়ি তৈরি করতে পারবে। 

ইতিপূর্বে যদিও এই সুযোগটা ছিলোনা এজন্য তারা এতোদিন কুদসে এসে জায়গা লিজ নিতো, ভাড়া থাকতো, কৃষি কাজ করতো। এখন তারা জমি কেনার সুযোগ পায়। এই জমি কেনার সুযোগ থেকেই মূলত থিউরেডর হার্জেল বিশ্ব ‘ইহুদী ওয়াকফ’ নামে একটা সংগঠন তৈরি করলো যার কাজ হলো টাকা কালেকশন করা। অর্থাৎ কুদস অঞ্চলে যারা যেতে চাইবে কিংবা স্থায়ীভাবে থাকতে চাইবে তাদের জমি কেনার জন্য টাকা সংগ্রহ করা। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে আরবদের থেকে জমি কেনার মাধ্যমে সেখানে স্থায়ী হতে লাগলো অনেক গুলো অঞ্চলের মালিক হয়ে গেলো। 

এখন আরেকটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,

ব্রিটিশরা যে সকল অঞ্চলে ঢুকে সে সকল অঞ্চলে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচেতনা ধ্বংসের জন্য সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দেয়। সেটার অনুরুপ দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশই। তারা আমাদের এই উপমহাদেশে সবশেষে পরাজিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে আমাদের যে মারাত্মক ক্ষতি করেছে,তার প্রভাব আজও বিদ্যমান যা আজকের হিন্দুত্ববাদ থেকে শুরু করে নানাবিধ রীতি-নীতি দেখলেই উপলব্ধি করা যায়। 

– এখন আসুন তারা কিভাবে কুদস অঞ্চলে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে শুরু করলো সেদিকে দৃষ্টিপাত করি। 

ইহুদিরা ফিলিস্তিন অঞ্চলে একসময় আসতো কৃষি কাজে ও ব্যবসার নাম করেই। কিন্তু তারা এসে আরবদের বুঝানো শুরু করলো দেখ উসমানীয়রা তোমাদের দখল করে রেখেছে । উসমানীয়রা হলো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তোমরা হলে নবীর বংশধর এজন্য তোমাদের উসমানীয়দের হাত থেকে মুক্ত হতে হবে। এধরনের একটা মনোভাব ফিলিস্তিনিদের সাধারাণ মানুষদের মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। 

এর ফলশ্রুতিতেই যখন উসমানীয়দের হাত থেকে কুদস অঞ্চলের ক্ষমতা ১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। তখন ব্রিটিশদের জেনারেল এলেমবিকে সংবর্ধনা জানান বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রধান ইমাম। এটা ছিলো ইহুদীদের কাজের ফল, এমনকি পরবর্তীতে দেখা যায় যে উসমানীয়দের থেকে ফিলিস্তিন কে মুক্ত করার জন্য যারা আন্দোলন চালিয়েছিলেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ফিলিস্তিনের অধিকাংশ আলেমরা। 

-কি সাংঘাতিক ব্যাপার একটু চিন্তা করুন! 

এর মধ্যে আবার অন্যদিকে দেখা যায় উসমানীয়দের মধ্যে কিছু লোক তৈরি হয় যারা পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার। ঐ যে যারা উসমানীয়দের সংবিধান পরিবর্তন করে ফিলিস্তিন কে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরব মুসলিমদের চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তার করে পূর্বে তৈরিকৃত ইহুদি কোষাগার (ইহুদী ওয়াকফা) থেকে টাকা দিয়ে অনেক ইহুদীদেরকে জমি কিনে দেয়ার মাধ্যমে কুদস অঞ্চলে স্থায়ী আবাসস্থল তৈরী করে দেয়া হয়। 

তখন ইহুদিরা আবার চিন্তা করলো! শুধু যদি ইহুদী কেন্দ্রিক জমি কেনা হয় তাহলে মুসলিমরা বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি করতে পারে অথবা আরব মুসলিমদের মনে সন্দেহের উদ্রেগ হতে পারে। অথবা যদি পরবর্তীতে ইহুদীদের সাথে কুদসের আরব মুসলিমদের ঝামেলা হয় তখন তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে কারণ, আরবদের ভুলভাল বুঝিয়ে উসমানীয়দের বিরুদ্ধ শক্তিতে কাজে লাগানো হচ্ছে। এজন্য তারা অন্যান্য ছোট ছোট গোত্রের লোকদের স্পন্সর করা শুরু করলো। এই কারণে আরবদের নজরটা শুধু ইহুদিদের দিকে না গিয়ে অন্যদের দিকেও যাওয়া শুরু করলো। 

আরবরা ১৯১৫ সাল থেকে উসমানীদের থেকে পৃথক হওয়ার আন্দোলন শুরু করে, এই আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বও করেন মসজিদে আকসার ইমাম সহ তৎকালীন ফিলিস্তিনের অধিকাংশ মসজিদ গুলোর ইমামরা। 

পরবর্তীতে ব্রিটাশরা সরাসরি কুদসের আরব মুসলিমদের বলতে শুরু করে আমরা তোমাদের স্বাধীনতা দেবো অর্থাৎ উসমানীয়দের থেকে মুক্ত করে দেবো। এই বিষয়গুলো জানার পর যদিও উসমানীয়রা এগুলো প্রতিরোধ করার জন্য অগ্রগামী হয়। কিন্তু তখন উসমানীয়দের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সমস্যার কারণে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি। যদিও চেষ্টা করেছিলো তবুও তারা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সকল ফোর্স নিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে রওনা হয়েও আবার ফিরে আসতে বাধ্য হয়। 

এজন্য তৎকালীন উসমানীয়দের স্থানীয় কুদস প্রতিনিধিরাই চিন্তা করেন যে, যেহেতু সেন্ট্রাল থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছি না তাই আমাদের নিজদেরকেই এই আন্দোলনের প্রতিরোধ গড়তে হবে। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত সামর্থ্য না থাকায় তারা পারেননি বরং এজন্য অসংখ্যা লোককে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। ১৯১৬ থেকেই শুরু হয় কুদুসে ইহুদিদের দখলদারিত্ব এবং এটা পরিপূর্ণভাবে ইহুদিদের হাতে চলে যায় ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। 

তখন থেকেই গাজা, মাদুস ও পশ্চিমদের অংশ থেকে শুরু করে পুরো কুদস অঞ্চল ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের হাতে পুঞ্জীভূত হয়।

এরপর শুরু হলো জায়োনিষ্টদের নতুন চাপ। এদিকে ইংরেজরা তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জায়োনিষ্টদের থেকে অনেক সহায়তা পেয়েছে। এজন্য প্রতিশ্রুতি রক্ষার ব্যাপারটাও বাদ দেয়া যায় না। তা-নাহলে বড় এক দাঙ্গার আশংকা করছিলো ইংরেজরা। এরপর সকল ইহুদিরা গণহারে কুদুস অঞ্চলে আসা শুরু করলো। এক পর্যায়ে ১ শতাংশ ইহুদি পরিনত হলো ২৫ শতাংশে। যার দরুন আরবদের পক্ষ থেকে আবার ব্রিটিশ বিরোধী একটা আন্দোলন শুরু হয়ে গেলো। এই অবস্থার মধ্যেই ইহুদিরা কোন সংকোচ ছাড়াই টাকা ধার করে নিয়ে কুদস অঞ্চলে হিব্রু ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করলো। এক পর্যায়ে আরবরা ব্রিটিশদের তুমুল বিরোধিতা শুরু করলো। এরপর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রস্তাব করলেন ইহুদিদের জন্য আলাদা একটা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার জন্য। 

যদিও এই সকল ইস্যুকে কেন্দ্র করে আরবদের মধ্যে অনেক প্রতিরোধের গ্রুপ তৈরি হয়। 

দেখা গেলো, সেই কুদসের তৎকালীন খতিব ‘কামিল’ যিনি কিনা ব্রিটিশদের প্রথম বরণ করে নিয়েছিলেন তিনিও আবার ব্রিটিশদের বিরোধিতা শুরু করলো। 

পরবর্তীতে ব্রিটিশরা অঞ্চল ভাগ করা শুরু করলো, জর্ডান নামে দেশ তৈরি করলো ফিলিস্তিনকে ফিলিস্তিন রেখে দিলো কিন্তু ফিলিস্তিনের কিছু অংশের মাঝেই জর্ডান রেখে দিলো এবং জর্ডানের বাদশা হলো দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ। 

এই ফিলিস্তিন ভাগ করাকে কেন্দ্র করেই আরবদের মাঝে তুমুল বিরোধিতার দাবানল জ্বলে উঠল। 

দেখা গেলো এই ইস্যু নিয়ে মুসলিমরা অর্থাৎ আরবরা মিলিটারী সংগঠন তৈরি করলো এবং এর বিপরীতে আস্তে আস্তে ইহুদিরাও মিলিটারী সংগঠন তৈরি করলো। ইহুদিরা তাদের টার্গেটকৃত এলাকাগুলোতে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে নানাবিধ নির্যাতন করা শুরু করলো। যদিও সে সময় সবেমাত্র ১৯১৭ সাল যখন ইহুদিরা তাদের দেশ ঘোষণাও করেনি। কিন্তু তার আগেই এ অবস্থা, নির্মম নির্যাতন, লুটতরাজের দৃশ্য যা আরবরা আগে কখনও বুঝতেই পারেনি। 

এমনকি যখন আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে ঝামেলা চলছিলো তখন ইহুদীরা তাদের পূর্ব দখলকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠা করে, বড় বড় ইন্ড্রাস্ট্রি তৈরি করে, গবেষণা সেন্টারগুলো তৈরি করে। এভাবে তারা মৌলিক দিক থেকে এগিয়ে যায়। 

অন্যদিকে দেখা যায় কুদুসের আরব মুসলিমরা পশ্চাৎপদ থেকে যায়। শিক্ষা-দীক্ষা থেকে শুরু করে শিল্প কারখানা পর্যন্ত সকল দিক থেকেই তারা পিছিয়ে যায়। শুধু কৃষিকাজ কিংবা ছোট খাটো ব্যাবসা বাণিজ্যকেই তারা জীবন চলার পাথেয় মনে করে। 

এভাবে যখন সকল দিক থেকে ইহুদিরা আগাতে থাকলো ঠিক তখনই হিটলার কর্তৃক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাদের জন্য বড় ধরনের একটি সুযোগ হয়ে দাঁড়ালো। 

এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে, জায়ন মুভমেন্ট যখন থিউরেডর হার্জেল তৈরি করছিলো তখন রাশিয়াতে ইহুদিদের উপর অত্যাচার চলছিলো আবার এখন যখন তাদের দেশ তৈরি করার একটা পর্যায়ে দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো এবং জার্মানিতে চরমভাবে ইহুদিরা নির্যাতিত হওয়া শুরু করলো। 

– এখন মূল বিষয় হলো দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টাকেই তারা বড় আকারের লজিক হিসেবে নিয়ে তাদের এই নির্যাতিত হওয়ার ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে দাবি তুললো- ইহুদীরা এখন চরম বিপদের মধ্যে আবর্তিত আছে। তাই এখন একটা নিজস্ব দেশ কিংবা ভূমি দরকার।

তারা তাদের এই দাবি পৃথিবীব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রচার করা শুরু করলো। 

তখন ব্রিটিশরাও তাদের এই দাবির পক্ষে সায় দিতে লাগলো কারণ আমরা তো জানিই ইতঃপূর্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীরা ব্রিটিশদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিলে। এভাবে খুব দ্রুতই তাদের এই আন্দোলন আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে বৃহৎ আকারে আত্মপ্রকাশ করলো। 

★ ৩য় আলেয়া:- 

এরই মধ্যে তারা তাদের তৃতীয় মুভমেন্ট চালু করলো। এর মাধ্যমেই তারা তাদের দখলদারিত্বের রাজ কায়েম করতে সক্ষম হয়।

একে বলা হয় হাগানাহ মুভমেন্ট ; অর্থাৎ এর মাধ্যমে তারা তাদের টার্গেটকৃত অঞ্চলে হুমকি দিয়ে হোক কিংবা হত্যাকান্ড চালিয়ে হোক কোন না কোন ভাবেই তারা সেই অঞ্চল দখল করেছে। তারপর সেখানে তারা তাদের স্থায়ী বসবাসস্থল বানিয়ে নেয়া শুরু করছে। এভাবেই তারা খুবই নির্মমতার পরিচয় দিতে লাগলো । 

এখন বিষয় হলো, আমরা জানি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালীন সময় প্রথম তারা শুধু ব্রিটিশদের সহযোগিতা পাচ্ছিলো তখন তারা নতুন করে চিন্তা করলো দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সবথেকে বড় শক্তিশালী দেশ আমেরিকাকেও তাদের হাত করতে হবে। তাই সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমেরিকার সাথে চুক্তি করে আমেরিকাকেও তারা হাত করলো। অর্থাৎ, যেই কথা সেই কাজ। 

আমেরিকার সাথে চুক্তি করার পর আমেরিকা তখন ঘোষণা করলো ইউরোপ অঞ্চল থেকে এক লক্ষ ইহুদীদের পুর্নবাসন করে ফিলিস্তিনের তেল-আবিব এ পাঠানো হবে।

এই ঘোষণা শুনে কুদসের আরব মুসলিমরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠার উপক্রম। তাই তাদের বিরোধিতার আন্দোলনের মাত্রা আরও দ্বিগুন হয়ে উঠলো। 

তখন ইহুদীরা বুঝতে পারলো এই মুসলিম আন্দোলনের বিষয়টা একটা বড় বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তাই তারা টুরিস্টের থিউরি কাজে লাগিয়ে সেই আলোকে আরবদের সাথে শান্তিচুক্তি করলো এবং বললো তাহলে আমরা এখন এই পুরো কুদস অঞ্চলকে সমান করে ভাগ করে নিই। এরপর তারা পুরো কুদস অঞ্চল কে ৭ টি ভাগে ভাগ করলো; ৩ টি আরবদের, ৩ টি ইহুদিদের, এবং বাকি ১টা হলো জেরুজালেম যেটাকে রাজধানী হিসেবে ঘোষনা করা হলো যদিও এই জেরুজালেমের সম্পূর্ণ কতৃত্ব হলো ইহুদীদের হাতে। এই অঞ্চল ভাগাভাগির সময় সকল উর্বর অঞ্চল গুলোই ইহুদিরা নিয়ে নেয়। 

* তারপর হঠাৎ করেই ব্রিটিশরা বললো আমরা এদেশ থেকে চলে যাবো। তখন আরবদের থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন আসতে থাকে। তোমরা এতোদিন ছিলে এখন কেন চলে যাবে?

ব্রিটিশরা বললো- “আমরা চলে যাবো ঠিকই কিন্তু স্থানীয়দের হাতে সকল কতৃত্ব দিয়ে যাবো। ” 

এখানে, বিষয় হলো ব্রিটেনরা কিন্তু বলেনি কাদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে যাবে। 

– আসল রহস্যা এখানেই লুকিয়ে আছে ! পরবর্তীতে কি হয় এখন সেটা দেখার পালা। 

ইসরাইলী সেনাদের পাহারায় মসজিদে আকসার প্রাঙ্গন।

দিনটা ছিলো ১৯৪৮ সালের ১৫ মে । তখন হঠাৎ করেই ব্রিটিশরা ঘোষণা করে দিলো আমরা আর এ অঞ্চলে থাকবোনা। তার ঠিক কয়েক দিন পরেই অর্থাৎ ১৫-২৬ মে এর মাঝামাঝি রাতে তেল-আবিব থেকে ইহুদি কর্তৃপক্ষের বরাতে একটা ঘোষনা আসলো আমরা এই অঞ্চলে আলাদা না থেকে বরং আলাদা একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবো। মজার ব্যাপার হলো সেদিন ইহুদীদের রাষ্ট্র ঘোষণার ঠিক ১১ মিনিট পর আমেরিকা ইহুদি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিলো। তার পরেই দেয় রাশিয়া….। 

– এখন চিন্তা করুন প্রত্যেকটি বিষয়ই কেমন পরিকল্পিত। 

এখান থেকেই শুরু হলো ইহুদী জায়ানবাদের নতুন পদযাত্রা। যা পৃথিবীব্যাপি নতুন এক শক্তি রুপে আত্ম প্রকাশ করে খোদার জমিনে অশান্তির দাবানল জ্বেলে দিলো। 

★ প্রিয় বন্ধুগন,,,,

এতোক্ষণ আমরা কুদস কি? ইহুদি জায়ানবাদের উত্থান কোথায়/কিভাবে? তারা কি মারাত্মক ভাবে প্লান সাজিয়ে পুরো পৃথিবীব্যাপি দখলদারিত্বের রাজ কায়েম শুরু করেছে এই ব্যাপারে জেনেছি। 

– এখন প্রশ্ন আসে কিসের উপর ভিত্তি করে তারা আজ অব্দি দখলদারত্বের রাজ কায়েম করে চলছে বা দাঁড়িয়ে আছে ?

আসুন ইহুদি জায়ানবাদের দখলদারিত্বের মূল ভিত্তিগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। 

– ১৯৪৫ সালে রুজভেল্ট, চার্চিল এবং স্ট্যালিন রাশিয়ার কিসিয়ায় ইয়াল্টা নামক বন্দরে বসে একটি নতুন দুনিয়ার (A New world order) পরিকল্পনা করে। তারা মানবতার স্লোগান দিয়ে এই কথা ঘােষণা করে যে- মানুষ শান্তি,শৃঙ্খলা ও সফলতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে। 

– কিন্তু সেটা কি আদৌও সম্ভব হয়েছে? নাকি সকল ক্ষেত্রেই শুধুই তাদের দখলদারিত্ব ও শোষনের বিস্তার লাভ করেছে। আসুন একটু পর্যালোচনা করে দেখি। এই বিষয়টি তুরুস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ড.নাজমুদ্দিন এরবাকান এভাবেই বুঝিয়েছেন:- “আজকের পৃথিবীতে যে কোনাে মানুষের এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট করতে হয়। আর বিমানের এই টিকিট IATA (International Air Transport Association) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। পৃথিবীর যে কোনাে দেশের, যে কোনাে বিমান কোম্পানিকে তার টিকিটের মূল্যের শতকরা ৯ ভাগ IATA-কে দিতে হয় । এমনকি তাদের অনুমতি ছাড়া কোনাে বিমান তার ইচ্ছামতাে বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারবে না। IATA প্রকাশ্যভাবে যতই আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠান হােক না কেন, সাধারণ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলাের মতােই তারা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তথা ইহুদি জায়ানবাদের নিয়ন্ত্রণে এবং এই শতকরা ৯ শতাংশ কমিশন অদৃশ্য পন্থায় তাদের কাছেই যায়। তেমনিভাবে যে কেউ দুনিয়ার কোনাে জায়গা থেকে অন্য কোনাে জায়গায় টাকা পাঠাতে চাইলে তার সেই টাকার গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য সর্বাগ্রে আমেরিকাতে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, চেস ম্যানহাটন ব্যাংক (Chase Manhattan Bank) অথবা এর মতাে যে কোনাে ব্যাংকের মাধ্যমে পৌছতে হবে। আর এই ব্যাংকগুলাে হলাে সাম্রাজ্যবাদীদের ব্যাংক। আর পাঠানাে টাকার শতকরা ১%-৫% পর্যন্ত কমিশন নিয়ে থাকে এরা। এমনিভাবে দুনিয়াকে শাসনকারী এই গােপন রাষ্ট্রে, এভাবে কোনাে কমিশন দেয়া ব্যতীত দুনিয়ার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কোনােভাবেই টাকা পাঠানাে সম্ভব নয় । 

এখন আমি যদি চিন্তা করি! না আমি তাদের এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করে নয় বরং অন্যভাবে টাকা পাঠাতে চাই এজন্য আমি জাহাজে যাব, কিন্তু এতেও আপনি মুক্তি পাবেন না। একটি জাহাজকে সমুদ্রে যাত্রা করার জন্য Lioyd নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স নিতে হবে । এই লাইসেন্স না নিলে জাহাজ কোনাে সমুদ্রে নামতেই পারবে না। Lioyd ও গােপন দুনিয়ায় নিয়ন্ত্রণকারীদের নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠান। দুনিয়ার অর্থনীতিকে পথ প্রদর্শনকারী বিশ্ব ব্যাংক এবং IMF নামক এই দু’টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশের ঋণ নেওয়ার যােগ্যতা মূল্যায়ন এবং তাদের ব্যাংকিং লেনদেনের ব্যবস্থা করে থাকে। সারা দুনিয়ার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এগুলাে হচ্ছে একই শক্তিবর্গের অধীনস্থ দু’টি প্রতিষ্ঠান। এই উদাহরণগুলাে বুঝতে হলে অনেকগুলাে খণ্ডে বই রচনার প্রয়ােজন । অবশেষে খেলাধুলা থেকে থিয়েটার পর্যন্ত, শিল্পকলা থেকে শিল্প পর্যন্ত, আইন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যন্ত অনেক কিছুই এই গােপন দুনিয়ার সরকারের (Secret world government) নিয়ন্ত্রণে। এজন্য দুনিয়ার ঘটনাবলীকে উপলব্ধি করার জন্য সবকিছুর আগে বর্তমান দুনিয়ার অ্যানাটমি (Anatomy) সম্পর্কে জানা আবশ্যক”।

★ এছাড়াও ইহুদি জায়ানবাদের অন্যতম ভিত্তি হলো পূজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা এবং শোষণেরও অন্যতম হাতিয়ার এটই। 

* আসুন পূজিবাদী অর্থব্যবস্থা ইহুদি জায়ানবাদের অন্যতম ভিত্তি কিভাবে হলো তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। 

বর্তমান পৃথিবীর দিকে যখন আমরা তাকাই একটা বিষয় খুব ভালোকরেই দেখতে পাই তাহলো- পুরো পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ হাতে গোনা ১০-১৫ জন ব্যাক্তির কাছে এবং যেখানে পৃথিবীর বাৎসরিক উৎপাদনের মোট আয় ৩২ ট্রিলিয়ন ডলার অথচ পুরো দুনিয়ার দারিদ্রতা দূর করার জন্য প্রয়ােজন হলাে পৃথিবীর মােট উৎপাদনের ১% তথা ৩১৫ বিলিয়ন ডলার। সেখানে ৬০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে শুধু ফুটবলের পিছনে!! 

~ শুধু কি এটুকুই? না, আর একটু খেয়াল করুন :- যে দুনিয়ার গায়ে আধুনিক,উন্নত ও উৎকর্ষতার সিল মারা হয় সেই দুনিয়ার সার্বিক অবস্থা ভেবে দেখেছেন কখনও? নাহলে দেখুন! 

বর্তমান এই পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের ৪০০ কোটিই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। ৩০০ কোটি মানুষের রাতে না খেয়ে ঘুমাতে হয়। ২০০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না। ২ লাখ মানুষ প্রতিদিন অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। ৩০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। যেখানে সাজসজ্জার প্রসাধনী, আনন্দ বিলাসে খরচ হয় হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার। 

পৃথিবীর সার্বিক ইমেজ আমাদের সামনেই। ইহুদি জায়ানবাদী ব্যাবস্থায় পরিচালিত আমাদের সোনার বাংলাদেশের আবস্থা জানবেন না? আসুন একটু ন্যাশনালিষ্ট/ জাতীয়তাবাদী চিন্তার খোয়াবে বিভোর হই। 

আমাদের দেশের এবারের বাজেট জানেন? 

এবারের ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে দ্বিতীয় সর্ব বৃহৎ খাতই হল সুদ! যে দেশে লক্ষ লক্ষ শিশু না খেয়ে বস্তিতে ঘুমায়, যে দেশে একজন শ্রমিক ১২ ঘণ্টা কাজ করে মাত্র ৮০০০ টাকা বেতন পায়, যে দেশে দরিদ্রতার কারণে মা-বাবা তার আদরের, কলিজার টুকরো সন্তানকে বিক্রি করে দেয়, যে দেশের মানুষ অর্থ যোগানের জন্য চোরাপথে জীবিকার সন্ধানে সাগরে ডুবে মরে, সে দেশ আজ ৬৩ হাজার কোটি টাকা সুদ দিচ্ছে!

কখনো প্রশ্ন করেছেন, এই টাকা কাদের দেওয়া হচ্ছে? এই টাকা দেওয়া হচ্ছে দেশের বড় বড় হোল্ডিংকে, জায়নবাদী ব্যাংক ও লবিদেরকে।

~ এছাড়াও এই করোনাকালীন সময়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কঠামোতে কি বিপর্যয় এসেছে লক্ষ্য করেছেন?

• BBS এর মতে করোনাকালীন সময়েই কর্মক্ষম মানুষ বেকার হয়েছে ৪ কোটি ৮২ লক্ষ! সরকারপন্থী গবেষক দল বলছে, প্রথম ৬৬ দিনে ৩ কোটি ৬৬ লক্ষ নতুন বেকার হয়েছে। আর CPD এর মতে ৫ কোটি। কিন্তু আসল হিসেব হলো ১০০ দিনে ৭ কোটি বেকার! (প্রখ্যাত গবেষক শ্রদ্ধেয় ফাইয়াজ স্যারের মতও এটিই।)

শতদিন চলে গেছে অনেক আগেই, এখন কী অবস্থা ভাবতে পারেন?

যারা আগেই বেকার ছিল, তাদের কী অবস্থা? এর প্রভাব কোথায় কোথায় পড়বে, কতটা ভয়াবহ আকারে ছড়াবে– ভাবতে পারি আমরা? যেখানে বর্তমান কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ৮ কোটি ৮০ লক্ষ।

• খাদ্য সংকটে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ মানুষ। 

– হ্যা….

এখনও কি এই দুনিয়ার গায়ে আধুনিক, উন্নত ও উৎকর্ষতার সিল মারবেন? আপনি নিজেই ভেবে দেখুন!

প্রিয় পাঠক,

 এতোক্ষণ আমরা ইহুদী জায়ানবাদের অর্থনৈতিক শোষন, রাজনৈতিক নিপিড়ন, মানবিক ও নৈতিক হামলার এক কুৎসিত চিত্র অবলোকন করলাম। 

আমাদের কাছে এই বিষয়টা খুব পরিস্কার ভাবেই প্রতীয়মান হলো যে, এই বিশ্ব মানবতা আজ জুলুমপূর্ন সমাজ ব্যবস্থার মোড়কে আর আবৃত থাকতে চায়না। বরং বিশ্বমানবতা চায় নতুন এক সূর্যদয় এক আদিল (ন্যায়ভিত্তিক) দুনিয়ার পুনর্জাগরণ। আর সেই আদিল(ন্যায়ভিত্তিক) দুনিয়ার উত্থান কি আদৌও কোনদিন ইসলাম ছাড়া সম্ভব?-কখনই সম্ভব নয়। 

ইতিহাস সেই সাক্ষীই বহন করে। কেননা, একমাত্র ইসলামী সভ্যতাই এই পৃথিবীর বুকে ১২০০-শ বৎসর ন্যায়ভিত্তিক শাসন ব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছে। এর একমার কারণ হলো ইসলামী রাষ্ট্র ব্যাবস্থার মূলনীতি হলো:-

আদালত প্রতিষ্ঠা করা। 

মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। 

চিন্তার স্বাধীনতা দেয়া। 

ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া। 

আমরা জানি, একমাত্র ইসলামী সভ্যতার সময়ে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোৎকৃষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। খোলাফায়ে রাশিদিনের যুগ দেখলেই তা বুঝা যায়। মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে পুরো জাজিরাতুল আরবে যাকাত নেওয়ার মতো একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেননা ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি হলো:- 

* প্রতিযোগিতা মূলক অর্থব্যবস্থা অর্থাৎ যে যত বেশি মেধা, শ্রম, যোগ্যতা বিনিয়োগ করবে সে তত অর্থের মালিক হবে। অন্যদিকে যে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে নানাবিধ দূর্বলতা বা প্রতিকূলতার কারণে পিছিয়ে যাবে তার জন্য রয়েছে যাকাত ব্যাবস্থা।

এখন আপনি নিজেই চিন্তা করুন! এই ব্যবস্থায় আবার দারিদ্রতা কিভাবে সম্ভব?

ঐ যে খুব বেশি সময় আগের বিষয় না -সুলতান ফাতেহ আল মাহমুদের সময়কালের কথা যখন ফ্রান্সের সাথে সুলতান ফাতেহ আল-মাহমুদের যুদ্ধ চলছিলো। ফ্রান্সের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুলতান ফাতেহ আল মাহমুদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন, লিখেছেন:-” হে আমিরুল মু-মিনিন এই যুদ্ধের কারণে আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। আমাদের দেশের মানুষ খেতে পারছেনা। না খেয়ে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। বেকারত্বের সংখ্যাও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।”

সেই যুদ্ধ চলাকালিন সময়েই সুলতান ফাতেহ আল-মাহমুদ চিঠি পাওয়ার পর বিন্দুমাত্র দেরি না করেই তাদের চাহিদার দ্বিগুণ খাদ্য রশদ পাঠিয়ে দিলেন এবং বললেন তোমাদের দেশে যত বেকার যুবক আছে তাদের সবাইকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দাও আমি তাদের কর্ম সংস্থানের ব্যাবস্থা করবো। 

– প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন কি পরিমান ইনস্যানিয়াৎ পূর্ন মনোভাব থাকলে এই কাজ করা সম্ভব!যেখানে যুদ্ধ চলছে ঠিক সেখানেই কি পরিমান ভালোবাসা ইনস্যানিয়াৎ!

এটা-ই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। 

“কুদুস মুক্ত করা কেনইবা এতো গুরুত্বপূর্ণ?” 

কুদস মুক্ত মানে শুধু অঞ্চলটাকে বিজয় করা নয় বরং কুদস মুক্ত মানে এই দুনিয়ার সকল জাহেলিয়াত, এই দুনিয়ার সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার নামই হলো কুদসকে মুক্ত করা। কেননা, পৃথিবী পরিচালনা করার মতো এই সকল মৌলিক বিষয়গুলোই আজ ইহুদী জায়নবাদীদের বিষাক্ত ছোবলের আওতায়। কুদস মুক্ত করার জন্য আমাদের সর্বপ্রথম এই মৈলিক বিষয়গুলো নিয়েই ভাবতে হবে। তাহলেই পূর্ব দিগন্তে এক নতুন সূর্য উদিত হবে। পৃথিবী সেই আলোকছটায় নতুন করে সবুজ ও সতেজ হবে। এক নতুন ন্যায় ভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।

বায়তুল মাকদিস

তাই আসুন, আমরা আজ ইহুদি জায়নবাদের পরিচালিত এই কুলোষিত ও বিষাক্ত সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে গিয়ে বিশুদ্ধ এক মানব সভ্যতার পুনর্জাগরণের জন্য কাজ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন৷ (আমিন)। 

কুদস মুক্ত হোক।

ন্যায় ভিত্তিক নতুন দুনিয়া নির্মিত হোক। 

ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ হোক।

সংকলকঃ আব্দুন নূর ইসলাম