একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে বিশ্ব সভ্যতা এক অনন্য মাত্রায় পৌছেছে, এনিয়ে সকলেই ঐক্যমত্য। প্রচলিত সত্য হলো- মানুষ সভ্য হয়েছে; অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে; মানুষ নতুন যুগে প্রবেশ করেছে; মানবসভ্যতা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
যেগুলোর পেছনে এক পরিকল্পিত বিশ্বব্যবস্থার অবদানও দাবী করা হয়।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- পৃথিবীর এক প্রান্তে মানুষ আমোদ-ফুর্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে সক্ষম হচ্ছে ঠিকই, মূলত যারাই এই তথাকথিত সভ্য ও সুশৃঙ্খল সমাজের কন্ঠস্বরের ভূমিকা পালন করছে, কিন্তু একই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মানুষ যুগ যুগান্তরের যুদ্ধ-বিগ্রহ, উপনিবেশ ও অবহেলার আস্তাকুঁড়ে নিপতিত হয়ে রাতের পর রাত না খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মৃত্যু বরণ করছে; যে সম্পর্কে পৃথিবীর সভ্য সমাজ যেন জানেনা এতোটুকুও!
যদি সমীকরণটি শুধু এতোখানিই হতো, তবু্ও ঠিক ছিল। কিন্তু উল্লিখিত পরিস্থিতির আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য এই যে, যে সমস্ত অঞ্চল সমৃদ্ধির সাথে নিজেদের পরিচালনা করছে, মূলত তাদের অদৃশ্য শোষণের ফলেই প্রান্তিক অঞ্চলগুলো আজ সকল ধরনের মানবিক চাহিদা ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এমনকি ওসকল অঞ্চলে যে পরিমাণ খাদ্য অপচয় হয়, তা দিয়েও পৃথিবীর ৮০ কোটি বুভুক্ষুর ক্ষুধা নিবারন সম্ভব। একদিকে পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা, অন্যদিকে স্তূপীকৃত খাবার ফেলে দেওয়া হচ্ছে ডাস্টবিনে। একদিকে খাবার অপচয়ের উৎসব হয়, অন্যদিকে ক্ষুধার্ত মানুষ অনাহারে থেকে মৃত্যুর প্রহর গোনে। মানবতার কী নির্মম পরিহাস! বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী ৮১ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়।
পরিসংখ্যান বলছে-
প্রতিবছর আমেরিকা শুধুমাত্র খাদ্য অপচয় করে ৪৪০০ কোটি ডলারের খাদ্য।
ইংল্যান্ডে ৪৩০০ কোটি ডলার।
আর রাজকীয় সৌদি আরব তো এই লিস্টে আরো উর্ধ্বে- তাদের বার্ষিক অপচয়কৃত খাদ্য মূল্য ১১৩৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ীও-
পৃথিবীর ৮২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ দিনে এক বেলা খাবার খেতে পারে। যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১০%। ২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী এই সংখ্যা আরো ৪ কোটি ৬০ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি এই বৃহৎ সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী।
জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, ৮২ কোটি ৮০ লাখের মতো মানুষ ক্ষুধা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়, যা আগের বছরের চেয়ে ৪ কোটি ৬০ লাখের বেশি। আর এ সংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ।
ক্ষুধায় ভোগা মানুষের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী এবং তাদের ৮০ শতাংশেরই বসবাস জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয়।
বলা হয়, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধার কারণে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে আজীবন শারীরিক ও জ্ঞানগত ক্ষতি হতে পারে।
এক দশকের ধারাবাহিক হ্রাসের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী ক্ষুধায় একটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। প্রাথমিকভাবে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অভিঘাত এবং করোনা মহামারির কারণে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অপুষ্টির শিকার ব্যক্তির সংখ্যা ১৫ কোটির বেশি বেড়েছে।
খাবারের দামও বেড়েছে। এফএওর ফুড প্রাইস ইনডেক্স (এফপিআই) চিনি, মাংস, খাদ্যশস্য, দুগ্ধ এবং উদ্ভিজ্জ তেলসহ খাদ্যঝুড়ির বৈশ্বিক মূল্যের পরিবর্তন নির্দেশ করে থাকে। এই ইনডেক্সে ৯৫ দশমিক ১ পয়েন্ট থেকে ১৪৩ দশমিক ৭ পয়েন্ট বেড়েছে।
এফএওর বাণিজ্য ও বাজার বিভাগের অর্থনীতিবিদ মনিকা তোথোভা বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হলেও বৃদ্ধির মাত্রায় অবশ্য দেশে দেশে ভিন্নতা আছে। কারণ, দেশগুলো এটা মোকাবিলায় ভিন্ন ভিন্ন নীতি গ্রহণ করে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক দেশ জাতীয় বাজেটের বিনিময়ে সুনির্দিষ্ট কিছু খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি দেয়, ভোক্তাদের জন্য দাম বেঁধে দেয় এবং বিশ্ববাজারে দামের ওঠানামা থেকে তাদের সুরক্ষা দেয়।’
জাতিসংঘের সর্বশেষ স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (এসওএফআই) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বে অপুষ্টিতে ভোগা বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী এশিয়ায় বাস করে। সেখানে ২০২১ সালে প্রায় ৪২ কোটি ৫ লাখ মানুষ ক্ষুধায় ভোগে। তবে ক্ষুধার ব্যাপকতা আফ্রিকাতে সবচেয়ে বেশি, যেখানে ওই বছর ক্ষুধায় ভুগেছিল ২৭ কোটি ৮ লাখ লোক।
খাদ্যসংকটের গ্লোবাল রিপোর্টের ২০২৩ সংস্করণ অনুসারে, তীব্র খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি হওয়া লোকের সংখ্যা ২০২২ সালে চতুর্থ বছরের জন্য বেড়েছে। তথ্যানুসারে গত বছর বিশ্বে ২৫ কোটি ৮ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে।
তোথোভা বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টির প্রাথমিক চালক হিসেবে অর্থনৈতিক অভিঘাতগুলো এখন সংঘাতকে ছাড়িয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা এবং বাজারব্যবস্থায় ভয়াবহ ব্যাঘাতসহ বৈশ্বিক অভিঘাতগুলো খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের স্থায়িত্বশীলতা এবং সক্ষমতা কমিয়েছে।’
২০২২ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খাদ্যশস্য, তেলবীজ এবং সার উৎপাদনকারী দুটি দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। এতে শস্য, সার ও জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হয়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী এফপিআই গত বছর রেকর্ড সর্বোচ্চে পৌঁছায়। বৈশ্বিক ক্ষুধার পূর্বাভাস নির্দেশ করে যে, চরম বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সামনে ক্ষুধা অব্যাহত থাকবে এবং তা আরও বিধ্বংসী রূপে হাজির হবে।
আরেক বেসরকারি সংস্থার জরিপ বলছে-
আজ প্রযুক্তির অগ্রসরতা, বাহ্যিক উন্নয়ন ইত্যাদি দেখা গেলেও মানবজাতির ইতিহাসে সবথেকে নাজুক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও জুলুমের মধ্য দিয়েই এখন পৃথিবী তার সময় অতিবাহিত করছে।
★ ৮০০ কোটি মানুষের ৪০০ কোটিই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।
★ ৩০০ কোটি মানুষের রাতে না খেয়ে ঘুমাতে হয়। ★ ২০০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না!
★ ২ লাখ মানুষ প্রতিদিন অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে!
★ ৩০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত!
যেখানে সাজসজ্জার প্রসাধনী, আনন্দ বিলাসে হাজার হাজার কোটি বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে! যেখানে দুনিয়ার মোট উৎপাদন হল ৩২ ট্রিলিয়ন ডলার, অথচ দুনিয়ার দারিদ্রতা দূর করার জন্য প্রয়োজন হলো মোট উৎপাদনের ১% তথা ৩১৫ বিলিয়ন ডলার। সেখানে ৬০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে শুধু ফুটবলের পিছনে!!
এহেন পরিস্থিতি থেকে মানবতাকে উদ্ধারের জন্য নিগৃহীত অঞ্চলগুলোকে সাথে নিয়ে মুসলিম অঞ্চলগুলোর নতুন অর্থনৈতিক জোট গঠনের বিকল্প নেই বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
তারা বলছেন- বিশেষত, চলমান লিবারেলিজমের করাল থাবা থেকে মানবতাকে মুক্ত করতে হলে ডি-৮ শক্তিশালী করার মাধ্যমে সেটি সম্ভব হতে পারে।
মুসলিম পোর্ট ডেস্ক