মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন গুলোর মধ্যে স্থাপত্য হলো অন্যতম নিদর্শন, কিন্তু মাটি দিয়ে তৈরি স্থাপনাগুলো যেন এই স্থাপত্যশিল্পকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
মুসলিম সভ্যতায় নির্মিত মাটি দিয়ে তৈরি মসজিদ গুলো দেখতে অনেক সুন্দর এবং মজবুত পাশাপাশি এগুলোর সময়সীমা অনেক দীর্ঘ হয়। গ্রীষ্মকালে এই মসজিদগুলোর ভিতর ঠান্ডা এবং শীতকালে উষ্ণ থাকতো। এমনকি মজার বিষয় হলো বর্তমান স্থাপত্যবিদরা টেকসই এবং মজবুত ভবনের জন্য উপেক্ষিত এই মাটির তৈরি ঘর নির্মাণের দিকে ফিরে আসছেন।
লারাবাঙ্গা মসজিদ, ঘানা,
১৪০০ এর দশকের শুরুর দিকে একজন মুসলিম ব্যবসায়ী আইয়ুবা এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। আইয়ুবা মূলত ব্যবসার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে সেখানে গিয়েছিলেন। এটি সুদানের স্থাপত্য শৈলীর আদলে নির্মিত এবং একইসাথে এটি দেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম এবং পশ্চিম আফ্রিকার স্থাপত্যগুলোর অন্যতম প্রাচীন মসজিদ।
খাতমিয়া মসজিদ, কাসালা, সুদান
১৮ শতকে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাচীন এই মসজিদটি টাকা পাহাড়ের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং খতমিয়া সুফি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রস্থল। এটি একটি মাটির ভবন যেখানে একটি সূক্ষ্ম অষ্টভুজাকার মিনার এবং মাটির কলামের সাথে মিলিতো একটি আইকনিক তোরণ রয়েছে।
আল বিদিয়া মসজিদ, সংযুক্ত আরব আমিরাত
ইতিহাসে যদিও এই মসজিদ নির্মাণের সময়কাল সঠিকভাবে পাওয়া যায়না তবে ধারণা করা হয় যে মসজিদটি ১৫ শতকের দিকে নির্মিত হয়েছে। মাটি ও পাথরের সমন্বয়ে তৈরি মসজিদটিতে কোন ধরনের কাঠের ব্যবহার করা হয়নি, তাই তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক কালনিরূপণ ব্যবহার সম্ভব নয়। মসজিদটি এখনোও ইবাদতের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জিঙ্গুরেবার মসজিদ, তিমবাকতু, মালি,
১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে মাটি দিয়ে নির্মিত এই মসজিদটি মালির বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটিকে ইতিহাসে বিভিন্ন ভাষায় (Djingareyber বা Djingarey Ber) উল্লেখ করা হয়েছে। আবু ইসহাক আল সহেলি নামের এক ব্যক্তি এই মসজিদটির নকশা তৈরি করেছিলেন যাকে তৈরিকৃত নকশার জন্য তৎকালীন মালি সম্রাট প্রথম মুসা ২০০ কেজি (৪০,০০০ মিথকল, মিথকল মূলত স্বর্ণ বা জাফরান এই ধরনের মূল্যবান ধাতু পরিমাপে ব্যবহার করা হয়) স্বর্ণ উপহার দিয়েছিলেন।
আল-মুহদার মসজিদ, তারিম, ইয়েমেন
ইয়েমেনের সবচেয়ে উঁচু মিনার আল-মুহদার মসজিদে অবস্থিত। ১৫০ ফুট উচ্চতার উঁচু সাদা এই মিনারটি সম্পূর্ণ কাদা মাটি দিয়ে তৈরি।
জেনির গ্রেট মসজিদ, মালি,
১৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই মসজিদটি বিশ্বের বৃহত্তম কাদা-মাটির বিল্ডিং। ১৯০৭ টি কাঠামো দিয়ে তৈরি এই মসজিদটি সুডানো-সাহেলিয়ান স্থাপত্যের সর্বোচ্চ উদাহরণ। এছাড়াও ভবনটির অ্যাডোব ( কাদা ও খড়কুটামিশ্রিত রোদে পোড়ানো ইট) প্লাস্টারিং এবং কাঠের ভারা দিয়ে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে এই মসজিদের দেয়ালগুলি কাদা দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
সেভেন স্লিপার মসজিদ, চেনিনি, তাতাউইন, তিউনিসিয়া
১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নির্মিত হওয়া এই মসজিদকে “Mosque of The Seven Sleeper” অর্থাৎ ঘুমন্ত সাতজনের মসজিদ নামে নামকরণ করা হয়।
কথিত আছে যে এই মসজিদের পাশে ঘুমন্ত ৭ জন বিখ্যাত আলেমের কবর দেওয়া হয়েছে আর তাই “Mosque of The Seven Sleeper” নামে মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে। তিউনিসিয়ায় অবস্থিত এই মসজিদের পাশে কিছু অস্বাভাবিক বড় সমাধিস্থলও (প্রায় ৪ মিটার দীর্ঘ) দৃশ্যমান রয়েছে।
গোবরাউ মিনার, কাটসিনা, উত্তর নাইজেরিয়া,
১৪ শতাব্দীতে নির্মিত মাটির তৈরি গোবরাউ মিনারটি পশ্চিম আফ্রিকার বৃহত্তম ভবনগুলির মধ্যে অন্যতম। মাটি দিয়ে তৈরি ৫০ ফুট উচ্চতার এই মিনারটি প্রথম মুসলিম রাজা সারকিন কাটসিনা মুহাম্মদু কোরাউ এর (১৩৯৮-১৪০৮) শাসনামলে সম্পন্ন হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।
ফখর আদ-দিন মসজিদ, সোমালিয়া
সোমালিয়ার ১ম মসজিদ আল-কিবলাতাইনের পর ২য় প্রাচীনতম এই মসজিদটি ফখর আদ-দিন নামে পরিচিত। ১৩শ শতাব্দীতে নির্মিত হওয়া এই মসজিদটি শহরের প্রাচীনতম অংশ হামার ওয়েইন মোগাদিশুতে অবস্থিত। এই মসজিদটিকে আফ্রিকার ৭ম প্রাচীনতম মসজিদ হিসেবে ধারণা করা হয়।
কং মসজিদ, আইভরি কোস্ট
১২ শতাব্দীতে এই মসজিদটি কাদা এবং লগ ব্যবহার করে সুদানিজ শৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছে। ৩২৮ মিটার (১০৭৬ ফুট) উচ্চতার এই মসজিদটি আইভরি কোস্টের ইসলামের সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শন যা বর্তমানেও ইবাদতের স্থান হিসেবে ব্যাবহৃত হয়।
বোলে মসজিদ, ঘানা
বোলে মসজিদ ১৭ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে ঘানায় মাটির তৈরি ৬ টি মসজিদের মধ্যে অন্যতম বোলে মাটির মসজিদ বা বোলে মসজিদ। এই মসজিদটি মাটি, কাঠ এবং লাঠির সমন্বয়ে সুদানিক স্থাপত্য শৈলীতে গঠিত। মসজিদটির অবস্থান এত সুন্দর এবং উঁচুতে রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে পুরো বোলে শহরকে উপভোগ করা যায়।
নন্দো মসজিদ, বান্দিয়াগড়া এসকার্পমেন্ট, মালি
খ্রিস্টীয় ১২শ শতকের শুরুর দিকে সম্পূর্ণ কাদা মাটি দিয়ে নির্মিত নন্দো মসজিদটি আজও ইসলামের স্থাপত্যশিল্পকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই মসজিদটি এত উচ্চতর শৈলীতে নির্মাণ করে হয়েছে যে এর স্থাপত্য ও কাঠামোগত দিকে বিবেচনা করে অনেক স্থাপত্যবিদরা বিভ্রান্তিতে পড়তে বাধ্য হয়েছিলো। নন্দো মসজিদ প্রতিষ্ঠাকে অনেকে মহান আল্লাহর উপহার বা দৈত্যের সৃষ্টি হিসাবে মনে করে থাকে।
আগাদেজ মসজিদ, আগাদেজ, নাইজার,
১৫১৫ সালে মাটি দিয়ে তৈরি এবং বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু কাদা-ইটের কাঠামোর মসজিদ হলো আগাদেজ মসজিদ। ১৫১৫ সালে আগাদেজ শহর নির্মাণের সাথে এই মসজিদটিও নির্মাণ করা হয়েছিলো। এর কিছুদিন পর শহরটি সোনহাই সাম্রাজ্যের দ্বারা দখল করা হয়েছিলো কিন্তু যদিও পরবর্তীতে শহরটি পুনরুদ্ধার করা হয় এবং মসজিদটির কিছু অংশ পুননির্মাণ করা হয়।
আতিক মসজিদ / আল-কবির মসজিদ, লিবিয়া
১২শ শতকে নির্মিত এই আতিক মসজিদটি সাইরেনাইকা অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীনতম মসজিদ। মসজিদটি তৈরিতে কাদা এবং চুনাপাথরের সমন্বয় করা হয়েছে। এছাড়া এই মসজিদটির গম্বুজ তৈরিতে কাদা মাটি এবং চুনাপাথরের পাশাপাশি পাম গাছের এলিম (পাম গাছ দিয়ে তৈরি একধরনের শৈলী) ব্যাবহার করা হয়েছে।
মাটির কারুকার্য মন্ডিত মসজিদ, সিন্ধু প্রদেশ, পাকিস্তান
সোরবাঙ্গো মসজিদ, আইভেরি কোস্ট
Sorobango (সোরবাঙ্গো) ১৭ বা ১৮ শতকের দিকে নির্মিত অ্যাডোব (কাদা ও খড়কুটামিশ্রিত রোদে পোড়ানো ইট) মসজিদ হিসেবে পরিচিত। উত্তর আইভরি কোস্টের অন্যান্য মসজিদের সাথে সুদানো-সাহেলিয়ান স্থাপত্যের অসামান্য স্থাপনাশৈলীর জন্য ২০২১ সালে এই মসজিদটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করেছে।
খারানাক মিনার, ইরান
এই মিনারটি প্রায় ১০০০ বছর পূর্বে সেলজুক সাম্রাজ্যের সময় নির্মাণ করা হয়েছিলো। এটি দেখতে গোলাকার আকৃতির। এছাড়াও এর বাইরের দিকগুলি দেখে মনে হয় যেন গোটা পৃথিবীর সাথেই এটি মিশে যেতে পারবে। এই জন্যই মূলত এটিকে Oscillating মিনার বা দোদুল্যমান মিনার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সংকলন- আব্দুল্লাহ আল মুঈন