মুসলিম পোর্ট

টিপু সুলতান—পুরো নাম সুলতান ফতেহ আলি সাহেব টিপু—দক্ষিণ ভারতের মহীশূর রাজ্যের সুলতান, যিনি টিপু সাহাব ও শের-ই-মহীশূর (মহীশূরের বাঘ) নামে খ্যাত ছিলেন। বীরত্ব, দেশপ্রেম, প্রশাসনিক দক্ষতা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে তাঁর অবদান ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর দেবনহল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন টিপু। যা বর্তমানে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরু গ্রামীণ জেলার একটি শহর। তাঁর পিতা হায়দার আলি ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি, যিনি পরবর্তীতে মহীশূর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৭৮২ সালে টিপু সুলতান মহীশূরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।

দ্বিতীয় অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধ চলাকালে তার পিতা রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতার মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা মাঙ্গলুরু ও বিদানুর আক্রমণ করেন। এছাড়াও তারা কালিকট ও মালাবার অঞ্চলের শাসকদের উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এই যুদ্ধে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের পরাজিত করেন। এছাড়া ‘মাঙ্গলুরু চুক্তি’-এর মাধ্যমে দ্বিতীয় অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

মহীশূরের স্থানীয় ভাষায় (কানাড়ী ভাষা) ‘টিপু’ শব্দের অর্থ ছিলো বাঘ। তিনি ছোটবেলা থেকেই বাঘ পুষতেন। তাঁর সিংহাসনের মাঝখানেও একটি বাঘের আকৃতি ছিলো। এছাড়াও তার পোষাক, তলোয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিসপত্রে বাঘের ছাপ থাকতো। তবে শের-ই-মহীশূর হওয়ার মূল কারণ ছিলো তার অসাধারণ ক্ষীপ্রতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলপূর্ণ রাজ্য পরিচালনা। বাবার সুযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন টিপু সুলতান।

টিপু সুলতান ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের এক দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষ। তিনি চার-চারটি অ্যাংলো- মহীশূর যুদ্ধ পরিচালনা করেন, যার মধ্যে দ্বিতীয় যুদ্ধে তাঁর কৌশলগত জয় ও ১৭৮৪ সালের মাঙ্গলুর সন্ধি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে ১৭৮৯ সালে ত্রাভাঙ্কোর ওপর তাঁর আক্রমণ তৃতীয় যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়, যেখানে সেরিংগপট্টম সন্ধির মাধ্যমে তাঁকে তাঁর রাজ্যের অর্ধেক ও দুই পুত্র ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর করতে হয়।

টিপু কেবল একজন যোদ্ধাই ছিলেন না, ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কও। তিনি রাজ্যে নতুন মুদ্রা, ক্যালেন্ডার এবং রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তাঁর অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে মহীশূর রেশম শিল্প এক নতুন দিগন্তে পা রাখে। তাঁর শাসনামলে মহীশূর বিশ্বমানের অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়, যেখানে শ্রমিকদের জীবনমান ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁর এসকল উদ্যোগ মহীশূরকে একটি শক্তিশালী সালতানাতে পরিণত করে।

প্রযুক্তিগত দিক থেকেও টিপু ছিলেন যুগান্তকারী। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয় লোহার খাপে মোড়ানো মহীশূরীয় রকেট। এটা পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রথম রকেট। যা পরবর্তীতে ব্রিটিশরাও অনুকরণ করে। তাঁর লেখা সামরিক গ্রন্থ ‘ফতহুল মুজাহিদি’-এ এই রকেট ব্যবস্থার কৌশলগত ব্যবহার বর্ণনা করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলোর সার্থক প্রয়োগ ঘটে পোলিলুরের যুদ্ধ ও সেরিংগপট্টমের অবরোধে।

টিপু সুলতান আন্তর্জাতিক মিত্রতা গড়ার ক্ষেত্রেও অগ্রগামী ছিলেন। তিনি উসমানী খেলাফত, ফ্রান্স ও আফগানিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ব্রিটিশদের মোকাবেলায় এক বৃহৎ ঐক্য গঠনের চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি ব্রিটিশদের বিতাড়িত ও দমন করার লক্ষ্যে উসমানী খেলাফত, আফগানিস্তান ও ফ্রান্সের নিকট সহযোগিতা চেয়ে দূত প্রেরণ করেছিলেন।

টিপু সুলতান সর্বপ্রথম ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন; যা ভেলোর বিদ্রোহ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, ভেলোর বিদ্রোহ ছিল ১০ জুলাই ১৮০৬ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সিপাহিদের দ্বারা সঞ্চালিত সর্বপ্রথম বিদ্রোহ। দক্ষিণ ভারতের ভেলোর শহরে সংঘটিত বিদ্রোহটি পুরো দিনব্যপী চলে। বিদ্রোহীরা ভেলোর দুর্গ দখল করতে ও ২০০ জন ব্রিটিশ সেনাকে হত্যা বা আহত করতে সক্ষম হয়। ভারতে ব্রিটিশদের ক্ষমতায় আসার পূর্বে এ বিদ্রোহ ছিলো তাদের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিরোধ।

১৮৫৭ সালের ১০ মে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া সিপাহি বিদ্রোহ বা সৈনিক বিদ্রোহ সকলের নিকট সুপরিচিত হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম বিদ্রোহ ছিলো ভেলোর বিদ্রোহ।

তাঁর সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সাথে হাত মেলালে তাঁর এই অমোঘ প্রতিরোধের পথ শেষ হয় চতুর্থ অ্যাংলো-মহীশূরী যুদ্ধে। ১৭৯৯ সালের ৪ মে সেরিংগপট্টম দুর্গ রক্ষার সময় টিপু সুলতান শহীদ হন। তাঁর শাহাদাত কেবল এক রাজ্যের পতন নয়, বরং উপমহাদেশের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরূদ্ধে প্রতিরোধের এক গর্বিত অধ্যায়ের অবসান।

টিপু সুলতান ইতিহাসের পাতায় কেবল একজন শাসক হিসেবে নয়, এক দুর্দমনীয় প্রতিরোধ ও প্রগতির প্রতীক হিসেবে বেঁচে আছেন। তাঁর জীবন ও আদর্শ আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতিটি সংগ্রামে।

-শফিকুল ইসলাম