গাজায় গত ৭ অক্টোবরের ঘটনা, বিশেষ করে গত পরশু রাতের ঘটনা আমাদের হৃদয়কে প্রকম্পিত করে তুলেছে। এসব ঘটনায় আমাদের কিছু শিক্ষা রয়েছে। বিগত কয়েক দিনের উপর্যুপরি হামলা ও গত পরশু ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া থেকে শুরু করে পুরো বিষয়টাতে আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কঠিন মুহূর্তেও গাজাবাসী ও হা মা সের নেতৃবৃন্দের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল আমাদের বিস্মিত করেছে।
হা মা স এ তুফান অভিযানে নামার আগে বিশ বছর সময় নিয়েছে। আর এ বিশ বছরের প্রস্তুতিকালে গোটা জাতি সকল ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতেও ধৈর্য ধরেছে, অভ্যন্তরীন নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আনুগত্য প্রদর্শন করেছে এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। এর ফলাফলই কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
প্রশ্ন হলো এ বিশ বছরে মূলত তারা কী করেছে?
১) তারা নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলেছে, তারা যোগ্য লোকবল গড়ে তুলেছে৷ তারা তাদের সন্তানদের জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষসহ নানাবিধ দুঃখ-কষ্ট, অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও তারা এ লক্ষ্য থেকে পিছপা হয়নি। যার ফলে বিশ বছরে লক্ষ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তারা গড়ে তুলেছে। নির্দিষ্ট ভিশন নিয়ে বিভিন্ন দেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ শেষে আবার গাজায় ফিরে গিয়েছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে তারা জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞানকে ধারনকারী এক প্রজন্ম গড়ে তুলেছে।
ডাক্তারদের কথাই যদি ধরি, এক গ্রুপ আহতদের সেবা করতে করতে হামলায় শহীদ হওয়ার পরে তাদের বিকল্প পরবর্তী গ্রুপ এসে স্থান দখল করে নেয়। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে তারা যথাসম্ভব পরিকল্পিত অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
তাদের অসংখ্য কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী রয়েছে। হামাসের দাবী অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ইসরায়েল যত ধরনের অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সেগুলোর যাবতীয় মেকানিজম হামাসের বিজ্ঞানীদের জানা এবং এগুলোকে প্রতিহত করার মতো অস্ত্রও তাদের কাছে রয়েছে। তারা শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত এক সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে, সেই সাথে উন্নত অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করেছে।
অর্থাৎ তারা একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক শ্রেণি, যোগ্য লোকবল ও দক্ষ সেনাদল তৈরি করেছে, যা তাদের অন্যতম বড় শক্তি।
২) স্থল অভিযানে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুটি রাষ্ট্র হলো আমেরিকা ও তুরস্ক। আমেরিকা ইসরায়েলকে সাহায্য করছে। অন্যদিকে মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তুরস্ক গাজার পাশে দাঁড়ায়নি (পূর্বে বিভিন্ন সময়ে তুরস্ক তাদের ক্ষমতা দেখিয়েছে; কোরিয়া, ইরাক, সিরিয়ায় তারা অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেছে)।
তবু আমেরিকার সাহায্যপুষ্ট ইসরায়েলের স্থলবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহায্যহীন গা জার অবিরাম পাল্টা হামলা সত্যিই বিস্ময়কর। গা জা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু গাজার হামলায় দখলদার ই জ রা য়েলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। বিশ বছর ধরে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল নির্মাণ এবং সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা থেকে শুরু করে অনেক ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে হা মা স অভিযানে নেমেছে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে এককভাবে লড়ে যাচ্ছে। ঈমান ও সাহসের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দেওয়ার মতো প্রজন্ম তারা তৈরি করেছে।
৩) খাদ্য, পানীয়, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, চিকিৎসা সামগ্রীর সংকট থাকা সত্ত্বেও গাজাবাসী ভীত নয়, বরং তারা এক শক্তিশালী জাতীয় জাগরণ তৈরি করতে পেরেছে। কুদসের মুক্তির জন্য, নিজেদের ভূমিকে টিকিয়ে রাখার জন্য, মসজিদে আকসায় ইসলামের পতাকাকে উড্ডীন রাখার জন্য তারা জাতীয় শাহাদাতের তামান্নাকে জাগ্রত রেখে নিরবিচ্ছিন্নভাবে শহীদ হয়ে যাচ্ছে। তাদের বক্তব্য একটিই, আমরা এ ভূমি ছেড়ে কোথাও যাবো না, সুতরাং কাপুরুষের মতো মৃত্যুবরণ না করে আমরা লড়াই করেই মরবো৷
পৃথিবী সাক্ষী, এ ধরনের চেতনা লালনকারী প্রজন্মকে কোনো অস্ত্র দিয়ে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
৪) হামাস এক আনুগত্যশীল দল, কর্মী, প্রজন্ম তৈরি করেছে। বিশ বছরের প্রস্তুতিকালে তারা অভ্যন্তরীন নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে ধের্য ধরে কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই নিজেদের প্রস্তুত করে তুলেছে। বর্তমানে পরিচালিত তুফান অভিযান নিয়ে অনেক নেতাকর্মী পূর্বে অবগত না থাকা সত্ত্বেও অভিযান শুরু হওয়ার পর সবাই একযোগে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তাদের মূল নেতা ই স মা ঈ ল হা নি য়া ফ্রন্টে থেকে তাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বহির্বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শেষ করে তিনি আবার দেশে ফিরে গিয়েছেন যুদ্ধ করার জন্য। এবং একজন ইস মা ই ল হা নিয়া শহীদ হলে যেন নেতৃত্বের সংকটে পড়তে না হয়, তাই চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী তারা ধাপে ধাপে বড় মাপের নেতৃত্ব তৈরি করে রেখেছে, যারা একে একে দায়িত্বে আসবেন ও অন্যরা অনবরত সাপোর্ট দিয়ে যেতে থাকবেন।
এক্ষেত্রে হামাস থেকে আমাদের শিক্ষা হলো–
- তারা ২০ বছর ইস্তেকামাতের সাথে কাজ করে প্রোডিউসার হিসেবে একটি প্রজন্ম গড়ে তুলেছে।
- তারা সুনিপুণ পরিকল্পনার ছক কষেছে এবং সবাই ধৈর্য্য ধারণ করে নেতৃত্বকে সহযোগিতা করেছে (এ বিশ্বাস স্থাপন ও ধৈর্যের নজরানা ইতিহাসে খুব কম পাওয়া যায়)।
- তারা একটি শক্তিশালী ভিশনারী আন্দোলন ও জাতীয় ভিত রচনা করেছে৷
- তারা জাতিকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে, জাতীয় শাহাদাতের তামান্না নিয়ে আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যেতে হবে (সর্বশেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা পর্যন্ত)।
- তারা সর্বদা ফ্রন্টে থেকে সংগ্রাম করবে এমন একদল যোগ্য নেতা তৈরি করতে পেরেছে।
সর্বোপরি তাদের আত্মবিশ্বাস ও প্রস্তুতি নিয়ে তারা মোটেই হতাশ নয়, ভয়ে প্রকম্পিত নয়৷ বরং তারা লড়ে যাচ্ছে, জাতীয় শাহাদাতের তামান্না নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হা মা স থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা নিজেরা শৃঙ্খলাবদ্ধ থেকে নিজেদের তৈরি করতে পারি, তাহলে আমরাও একটি জাতীয় জাগরণের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো।
সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে বলতে হয়, তারা কতটুকু সফল হবে কিংবা ব্যর্থ হবে জানি না, তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই একটি ফলাফল দিবেন। কুদস একদিন মুক্ত হবেই, ইনশাআল্লাহ। আর এজন্য গাজাবাসী তাদের ত্যাগের সর্বোচ্চ নজরানা গোটা মুসলিম উম্মাহকে দেখিয়ে দিয়েছে। গোটা বিশ্ব যেখানে মৌনতাকে বেছে নিয়েছে, সেখানে তারা একাই লড়ে গিয়ে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে; অতএব এই প্রজন্মকে কোনভাবেই পরাজিত করা সম্ভব নয়, বিজয়ী হবেই হবে।। ইনশাআল্লাহ…
লেখক- হাসান আল ফিরদাউস