মুসলিম পোর্ট

চীনা মুসলমানদের দুটি বড় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি হচ্ছে উইঘুর এবং অপরটি হুই। হুই সম্প্রদায় একটি সমগোত্রীয় জাতিগোষ্ঠী (Ethnically homogeneous group) নয়। আরব, পারস্য, মধ্য-এশিয়া এবং মঙ্গোলিয়া সহ প্রভৃতি দেশ থেকে তাদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন সময়ে চীনে এসে জড়ো হয়েছিলো। তবে বর্তমানে তারা চীনা ভাষা ও সংস্কৃতির লালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। হুইরা চীনা ভাষায় কথা বলে এবং চীনে সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম তারা। চীনের প্রায় সবগুলো শহরেই কমবেশি তাদের বসবাস রয়েছে। এমনকি হানদের সাথে আন্তঃগোত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে তাদের তেমন কোনো বাধা নেই।

ধর্মীয়ভাবে তারা সবাই ইসলামের অনুসারী। চীনের ভেতরে বা বাইরে হুই শব্দটি দ্বারা মুসলিম বুঝানো হয়ে থাকে। এ যেন মুসলমান শব্দের একটি প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। চীনা মুসলমানদের একটি বড় অংশ সুন্নি মতাবলম্বী। ৫৮.২% হুই মুসলমান প্রধানত সনাতন ইসলামে বিশ্বাসী এবং বাকিদের বড় একটি অংশ সুফি মতবাদে বিশ্বাসী। এর মধ্যে কাদেরিয়া মতবাদে বিশ্বাসী রয়েছে ২১ শতাংশ। কিছু অংশ রয়েছে শিয়া মতাবলম্বী, তারা প্রধানত ইসমাইলিয়া। এদের মধ্যে জিনজিয়াং এর তাসকুরগান এবং সারিকুলের তাজিকরা আছেন। জিংজিয়ানে হুইদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও গোটা চীনেই তারা ছড়িয়ে আছে। তারা ইসলামের প্রতি একনিষ্ঠ থাকলেও বর্তমানে পরিবেশগত কারণে মুসলিম পরিবারের সন্তানদের কেউ কেউ অন্য ধর্ম গ্রহণ কিংবা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করা থেকে বিরত থাকার স্বাধীনতাও গ্রহণ করে চলছে।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওফাতের মাত্র ১৯ বছর এবং মুসলমানদের পারস্য বিজয়ের মাত্র এক বছর পর ৬৫১ সালে প্রথম আরব মুসলমান প্রতিনিধিদল তাং শাসনামলে চীনে এসেছিলেন। এ সময় থেকেই প্রধানত আরব এবং কিছু পারসীয় বণিক চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বসতি স্থাপন করেন।

৭৫৮ সালে তাং সম্রাট ‘আন লু সান’র বিদ্রোহ দমনের জন্য আব্বাসীয় খলিফাদের কাছে বিশ হাজার সৈন্য পাঠাতে অনুরোধ জানান। যুদ্ধ পরবর্তীতে আরব ও পারসীয় সৈন্যরা চীনে থেকে যান এবং নিংজিয়া ও গানসু’র উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। আবার ৮০১ সালে চীনের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের ইউনানে নান ঝউ সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিব্বতীয়রা কুড়ি হাজার আরব এবং Sogdian সৈন্য নিয়োগ করেছিলেন। যুদ্ধে তিব্বতীয়রা পরাজিত হলেও মুসলমান সৈন্যরা চীনেই থেকে যান। ১০৭০ ও ১০৮০ সালে চীনের উত্তরাঞ্চলের সুং সম্রাটের অনুরোধে সং সাম্রাজ্য এবং খিতান সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি বাফার অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য পনেরো হাজার আরব সৈন্য আগমন করেন। মোঙ্গল শাসক কুবলাই খান ১২৭০ সালে মধ্য এশিয়া থেকে প্রায় তিন লক্ষ মুসলমানকে চীনে এনেছিলেন। আপদকালীন সময়ে সৈন্যের কাজ করার জন্য তাদের আনা হয়েছিল। ১২৭৯ সালে দক্ষিণ চীন বিজয়ে তারা কুবলাই খানকে সাহায্য করেছিল। শান্তির সময়ে তারা বণিক, কৃষি শ্রমিক এবং দক্ষ কারিগর হিসেবে সমগ্র চীনে বসতি স্থাপন করেন। কুবলাই খানের একজন নাতি ‘আনন্দ খান’ একটি পারসিয়ান পরিবারে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। ১২৮৫ সালে তিনি গানসু, নিংজিয়া ও সিচুয়ান সমন্বয়ে গঠিত তাংগুট রাজ্যের রাজপুত্র হন। তাংগুট রাজ্যের জনগণ তিব্বতীয় ও চৈনিক বৌদ্ধধর্মের সমন্বয়ে একটি বৌদ্ধ ধর্মমত পালন করতো। তার চাচাতো ভাই গাজনা খান ও ‘আনন্দ খান’ ১২৯৫ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে প্রায় দেড় লক্ষ মোঙ্গল সৈন্য এবং অধিকাংশ তাংগুট ইসলামে দীক্ষিত হন। এসব মুসলমানদের সংস্পর্শে ইসলামের মহানুভবতাকে লক্ষ করে অসংখ্য স্থানীয় চৈনিক জনগোষ্ঠী ইসলামে দীক্ষিত হন। এভাবেই ১৩৬৮ সালে মোঙ্গল শাসিত ইউনান সাম্রাজ্য শেষ হওয়ার আগেই হুইরা চীনের সবচাইতে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। অন্যদিকে, মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আদতে একজন হুই ছিলেন বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ননা করেন। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিষয়টি সযত্নে গোপন রাখা হয়েছিল বলেও তারা মত প্রকাশ করেন। মোঙ্গলদের যুদ্ধে পরাজিত করার পর তিনি হুইদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করেন। হানদের কুসংস্কার থেকে তাদের রক্ষার জন্য তিনি হুইদের জন্য হানদের বিবাহ করা, চীনা রীতিতে পোশাক পরিধান ও কথা বলা বাধ্যতামূলক করেন।

মিং শাসনামলে এ সুবিধাভোগের ফলে পরবর্তী মানচু-শাসিত কিং সাম্রাজ্যে হুইরা নিপীড়নের সম্মুখীন হন। পূর্ব পাকিস্তানের উইঘুররাও এই নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ১৬৪৮-১৮৭৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কিং সাম্রাজ্যের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১০টি ব্যর্থ বিদ্রোহে কয়েক লক্ষ হই ও উইঘুর নিহত হন। এ সময়ে তিব্বতীয়রাও মানচু ও হানদের নিপীড়নের সম্মুখীন হলেও তারা হুইদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। এমনকি পঞ্চম ‘দালাই লামা’ মানচু রাজদরবারে যাবার পথে হুই ধর্মীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করে দার্শনিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন।

উনিশ শতক ছিল হুইদের সবচেয়ে ক্রান্তিকাল। তারা ধর্মীয় স্বাধীনতার সবটুকুই প্রায় হারিয়ে ফেলে। অবশেষে উনিশ শতকের শেষভাগে দু’দফায় হুইরা রুশ শাসনাধীন পশ্চিম তাজিকিস্তানে দেশান্তরী হন। প্রথম দলটি ১৮৭৮ সালে মানচু শাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহের পর গানসু ও সানঝি থেকে কাজাকিস্তানে গমন করেন। দ্বিতীয় দলটি ১৮৮১ সালে পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে পশ্চিম তাজিকিস্তানে এসেছিলেন। ১৮৭১ সালে রুশরা অঞ্চলটি দখল করে, তবে সেন্ট পিটার্সবার্গ চুক্তির আওতায় ১৮৮১ সালে অঞ্চলটি চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় অধিবাসীদের চীন বা রুশ নাগরিকত্বের মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এ দু’দফায় দেশান্তরী হুইগণ প্রধানত কিরগিজস্তানের চু নদীর অববাহিকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। তারা নিজেদের ‘ডাংগন’ হিসেবে পরিচয় দেন।

বর্তমানে চীনা হুইগণ পশ্চিমা ও পূর্ব নামে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। পশ্চিমা হুইগণ প্রধানত নিংজিয়ায় বাস করেন। এছাড়াও তারা গানসু, কিংহাই, মঙ্গোলিয়ার পশ্চিমাঞ্চল, সানজি, হেনান ও হেবেই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য রয়েছে। অন্যদিকে পূর্ব হুইরা প্রধানত মঙ্গোলিয়ার পূর্ব অংশে বাস করেন। চীনে রাজনৈতিক স্থিরতা বজায় থাকলেও হুইরা তাদের সুযোগ সুবিধা পুরোপুরিভাবে ভোগ করার অধিকার পাচ্ছেন না। ফলে প্রায়শই নানারকমের দুঃসংবাদ মুসলমানদের ঘিরেই থাকে।

সংকলণঃ মাহদী হাসান