মুসলিম পোর্ট

ফিলিস্তিনের গাজা এখন শুধুমাত্র একটি ধ্বংসের প্রান্তরেই সীমাবদ্ধ নয় যেমনটি আমরা মিডিয়ায় দেখে থাকি, বরং প্রতিটি চূর্ণ-বিচূর্ণ বাড়ি যেন অমোচনীয় বেদনার সাক্ষী, বুলেট-বোমার শিকার প্রতিটি শিশু যেন বীরত্বের এক অনবদ্য কাব্য। জুলুমের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য লড়তে থাকা গাজার অধিবাসীরা রক্ত দিয়ে একটি ইতিহাসের সৃষ্টি করেছেন। আর এই রক্তাক্ত ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় আজ আমাদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আমরা কি চলমান এই গণহত্যার শুধুই এক নীরব দর্শক হয়ে থাকব? সাময়িকের সামান্য আবেগে ভেসে আবারও দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যাবো? নাকি আমরা তাদের মতো হব, যারা অবশিষ্ট থাকা সবটুকু শক্তি দিয়ে ন্যায়ের পক্ষে আবিচল থাকে আর নিজেদের নাম ইতিহাসের পাতায় সোনালি হরফে অমর করে রাখে?
আমরা অনেকেই মনে করি, আমাদের হাতে আসলে কিছু করার নেই, আমরা কিছু কি আর বদলাতে পারব, এইখানে আমাদের ভুমিকাটাই বা কী— মনে রাখবেন, অন্যায় তখনই টিকে যায় যখন আমরা নিশ্চুপ থাকি। আসলে সত্যের থেকে শক্তিশালী হাতিয়ার আর দ্বিতীয়টি হয় না। আপনি নীরব আছেন বলে যে আপনি নিরপেক্ষ তা কিন্তু নয়। প্রয়াত বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা ডেসমন্ড টুটুর কথায় তাই বলতে হয়, “যখন আপনি অন্যায় দেখেও নিরপেক্ষ থাকেন, তখন আপনি দমনকারীর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছেন। কাজেই, আপনিও জড়িত সেই অবিচারের সঙ্গে।“
যদি আদতে সমাধানের অংশ হতে আমরা নাই পারি, অন্ততপক্ষে মিথ্যা ও ভ্রান্ত তথ্য প্রচার কিংবা নির্যাতন-নিপীড়নের পক্ষে অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থাকি। আমরা হয়ত  মজলুমদের সরাসরি সাহায্য করতে পারব না কিন্তু আমরা তো জানি সত্য কী। এই সত্যকে আঁকড়ে ধরে কি আমরা অন্যায়ের অবসান ঘটানোর ছোট একটি মাধ্যম হতে পারি না? অবশ্যই পারি। কারণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা এখনো সত্য বলতে জানি। 

আমরা যেন তাদের মত না হই যারা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে, যেখানে জালিমকে মজলুম আর মজলুমকে জালিম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আসুন, মজলুমদের পাশে দাঁড়াই। আমাদের দেওয়ার মতো একমাত্র জিনিস যদি থাকে তবে সেটা সত্য। তাই এই সত্যকে আমরা বিকৃত না করে যেন অক্ষুণ্ণ রাখি, ভুল বা মিথ্যা তথ্য না ছড়াই। নিঃসন্দেহে এটিই এখন সময়ের দাবি।

গাজার মানুষের ওপর চলমান এই বর্বরতা কি শুধুই সামরিক সংঘাত? মোটেই না। সজাগ হোন, এই যুদ্ধ সত্যকে পালটে দেয়ারও পায়তারা। তেলাবিবের গোলটেবিল বৈঠকের বিষয় শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ নয় বরং জনসচেতনতা, অতীতের স্মৃতি সব মুছে ফেলা। ওই শকুনদের চোখ শুধু গাজার ভুমির মধ্যেই নিবদ্ধ নয়, ওরা তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও সমূলে ধ্বংস করে দিতে চায়। তাই আমাদের লড়াই শুধু রণক্ষেত্রেই আর সীমাবদ্ধ নেই বরং চিন্তা, বিবেক ও নৈতিকতার বিশাল জগতেও বিস্তৃত ।

গাজার পক্ষে আমাদের একটি বিপ্লবের ইতিহাস রচনা করতে হবে। আর তা এমনি এমনিই সম্ভব হবে না। সহানুভূতির চাদর মুড়ে শুধুমাত্র গণহত্যার নীরব দর্শক হয়ে আরও ধ্বংসলীলা দেখার জন্য অপেক্ষা করা আর নয়। আমাদের ওপরেও রয়েছে দায়িত্বের বিশাল ভার। এই দায়িত্ব সত্য বলার, মজলুমের কণ্ঠস্বর হওয়ার, এবং মিথ্যা প্রচারকে আর ছড়িয়ে যেতে না দেওয়ার।

মনে রাখতে হবে, সত্য বলতে কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। এখন সত্য বলা মানে গাজাকে সাহায্য করা। সাহায্য করা প্রতিটি সন্তানহারা বাবাকে, প্রতিটি কোল খালি হওয়া মা কে। যত বিপত্তিই হোক না কেনো আমাদের সত্য বলতে হবে। সত্যের এই পথ পরিত্যাগ করা যাবে না। এইখানে মিথ্যা প্রশ্রয় দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না, আর মিথ্যা প্রচার তো দুরের কথা। রক্তপিপাসু জালিম, জালিমই। আর এটাই সত্য।  নিষ্পাপ শিশুদের প্রাণ ও আবাসন ধ্বংসের খেলায় তারা মত্ত, এই ধ্বংসলীলার ন্যায়সঙ্গতা প্রতিষ্ঠা করার কোন সুযোগ নেই এইখানে।

জায়নাবাদী শকুনরা চায় আমরা যেন সব ভুলে যাই। ভুলে যাই রক্তমাখা এই ইতিহাস। ওরা এই বিশ্বাসের ওপর বাজি ধরেছে যে, বৃদ্ধরা মারা যাবে আর তরুণরা ভুলে যাবে। কিন্তু আমাদের অন্তরে এই আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর এটি ভুলে যাওয়ার অবকাশই নেই।

প্রতিটি মুহূর্তে প্রশ্ন উঠে—এই সংঘাতে আমাদের অবস্থান কোথায়?
আমরা কি তাদের মধ্যে পড়ব, যারা নির্বিকার গণহত্যার নৃশংস দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ঠিকই, কিন্তু তারপর যেন কিছুই ঘটেনি বলে দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যায়? নাকি আমরা তাদের মত হব, যারা দৃঢ়ভাবে দাবি করে যে গাজা তার সংগ্রামে একা নয়, বরং আমরাও এই সংগ্রামের অংশ এবং তাদের লক্ষ্য ও সংগ্রামের সহযাত্রী?

আমরা সবাই সরাসরি ময়দানে নায়ক হতে পারব না ঠিক, কিন্তু আমাদের অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের কথা ও কাজ যেন মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের জয় নিশ্চিত করে।
আমাদের ইতিহাস লিখতে হবে সাহসী কণ্ঠস্বর ও সৎ কর্মের মাধ্যমে—নীরব থেকে নয়। অত্যাচারীরা বাজি ধরেছে—সবাই একদিন ভুলে যাবে; কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সত্য কখনো মরে না, যতক্ষণ না আমরা একে পরিত্যাগ করি।

– আদনান মাইদান

অনুবাদঃ নূর সিদ্দিক রেদওয়ান